রহস্যময় মৃত্যুকাহিনী বিখ্যাত তারকাদের

0
882

খুলনাটাইমস বিনোদন ডেস্কঃইসলাম ধর্মমতে, মৃত্যু হলো জাগতিক দেহ থেকে আত্মার পৃথকীকরণ এবং মৃত্যু পরবর্তী জগত অর্থাৎ আখিরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। সকল জীবের জন্যই মৃত্যু এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তাই সকলেই স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা করে। কিন্তু মানুষের হিংসা-প্রতিহিংসা, স্বার্থ, লোভ-লালসা অনেক সময় মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার সঠিক কারণ এখনও অজানা। রহস্যজনক এসব মৃত্যু শুধুই আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, নাকি হত্যা সেই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি আজও। অনেক বড় বড় তারকা ব্যক্তিত্বও এমন রহস্যময় মৃত্যুর শিকার হয়েছেন যুগে যুগে। প্রিয় এসব তারকার রহস্যজনক মৃত্যু তোলপাড় করে তোলে ভক্তদের হৃদয়। তাই রটনাও ছিল অনেক এসব মৃত্যুকে ঘিরে। রহসস্যজনক মৃত্যুর শিকার এমন কিছু তারকার কথাই জানব আজকে।

দিব্যা ভারতী

মাত্র ১৬ বছর বয়সে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখা এক ধুমকেতুর নাম দিব্যা। তামিল সিনেমা ‘বব্বিলি রাজা’ খ্যাত মিষ্টি মুখের অভিনেত্রী দিব্যা ওম প্রকাশ ভারতী তার মাত্র ২-৩ বছর ক্যারিয়ার জীবনে প্রতিভার সুস্পষ্ট প্রমাণ রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে তামিল সিনেমায় তাকে প্রথম দেখা গেলেও অভিনয় আর সুমিষ্ট হাসির জোরে পরবর্তীতে ১৯৯২ সালেই ‘বিশ্বআত্মা ‘ সিনেমার মাধ্যমে জায়গা করে নেন বলিউডে। সেবছরেই নবাগত শাহরুখ খানের বিপরীতে ‘দিওয়ানা‘ সিনেমার মাধ্যমে আশাতীত সাফল্য লাভ করেন এবং অর্জন করে নেন ‘ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ মহিলা অভিষেক পুরস্কার’। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে তিনি ১৪টি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেন, যা সাফল্য ও সংখ্যার হিসাবে আজও রেকর্ড হয়ে আছে বলিউডপাড়ায়।

স্বল্পায়ু, পুতুল সদৃশ এই তারকা মাত্র ১৯ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন।১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল, নিজ বাসভনের পাঁচতলা থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটে তার। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, মদ্যপ অবস্থায় ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান তিনি। আবার অন্য সূত্রে বলা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকালে তিনি এ পথ বেছে নেবেন এমনটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না নিকটাত্মীয়দের কাছে। তবে দিব্যা ভারতীর ভক্তদের কাছে এটা নিছক মৃত্যু ছিল না। তারা তার আকস্মিক মৃত্যুকে হত্যা বলে দাবী করেন।

দিব্যার হত্যাকারী হিসাবে তার স্বামী সাজিদ নাদিদওয়ালাকেই সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রেখেছিল মিডিয়া ও ভক্তরা। এছাড়া, সাজিদের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথেও সংযোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একই বছর ১৩ মার্চ মুম্বাইয়ে এক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। দিব্যা এমন কিছুর সাক্ষী ছিলেন, যার কারণে তাকে মেরে ফেলা জরুরী ছিল- এমনটাও সন্দেহ ছিল অনেকের।

 

পুলিশ শেষপর্যন্ত রহস্যের সমাধান করতে না পারায় ১৯৯৮ সালেই বন্ধ করে দেয় দিব্যার মৃত্যুর কেস। টাকার বিনিময়ে তদন্ত রিপোর্ট সাজানো এবং চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেস বন্ধ করে দেওয়া হয়- এই ধারণাও নিছক অমূলক ছিল না তখন। তাই দিব্যা ভারতীর মৃত্যু আজও সকলের কাছে রহস্যই রয়ে গেছে।

মাইকেল জ্যাকসন

পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসন তার নাচ, গান ও ফ্যাশনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জায়গা করে নেন বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল বিক্রিত অ্যালবামের অধিকারী সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আশির দশকে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীন প্রথম সফল কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জায়গা করে নেন। তার নাচের ভিতর রোবট, মুনওয়াক ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

২০০৯ সালের ২৫ জুন, ‘King of Pop‘ মাইকেল জ্যাকসনের আকস্মিক মৃত্যু সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় সমাজের সামনে হীনমন্যতায় ভুগতেন তিনি। তাই প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজেকে ফর্সা করে তোলেন। এছাড়াও তিনি ত্বকের সমস্যায় ভুগতেন। এসবের দরুণ তাকে দীর্ঘমেয়াদী পেইন কিলার সেবন করতে হত, যা তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিশ্চিত করেন ডাক্তারগণ। কিন্তু একইসাথে তার মৃত্যু নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিতর্ক।

প্রাথমিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এমনটা প্রচার হলেও দ্য সান পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়,ডেমারোল নামক এক ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জেকশনের মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ তার মৃত্যুবরণের কারণ। মৃত্যুর সময় তার সাথে উপস্থিতির প্রমাণ মেলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কনরাড মারের। কিন্তু রহস্য ঘনীভূত হয় যখন তার ডেথ সার্টিফিকেটে অন্য কারো সাইন দেখা যায়।

তদন্তে মৃত্যুর সময়ে তার দেহে ছয় ধরনের মাদকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়। কিন্তু পপসম্রাটের মৃত্যুর জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসের করোনার কার্যালয় তার চিকিৎসক কনরাড মারেকেই দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। যদিও আইনজীবীরা দাবী করেন, মাইকেল নিজেই ওষুধটির অতিরিক্ত সেবনে মৃত্যুবরণ করেন। তাই মাইকেল নিজের বেখেয়ালি ওষুধ সেবনে মৃত্যুবরণ করেন নাকি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা তা আজও রয়ে গেছে রহস্যের আড়ালে।

মেরিলিন মনরো

আবেদনময়ী হাসির মায়াজালে লাখ লাখ তরুণের হৃদয়ে ঝড় তোলা একাধারে মার্কিন অভিনেত্রী, গায়িকা, প্রযোজক ও মডেল মেরিলিন মনরোর ঘটনাও অনেকটা একই। খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকালেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। তার এই অস্বাভাবিক মৃত্যু ভক্তদের কাছে এসেছিল একরাশ হতাশা হয়ে। ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট লস অ্যাঞ্জেলেসের ব্রেন্টউডে নিজের বিলাসবহুল বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। ব্যক্তিজীবনের হতাশা থেকেই মৃত্যু এই মোহনীর, নাকি এর পেছনে দায়ী অন্য কারো প্রতিহিংসা- তা আজ মৃত্যুর অর্ধশত বছর পরেও রহস্য হয়েই থেকে গেছে মনরোর ভক্তদের কাছে।

রুপালী পর্দার সফল এই নারীর ভূবনমোহিনী হাসির আড়ালের ব্যক্তিজীবন ছিল বহু কঠিন পরীক্ষার সম্মিলন। পিতৃপরিচয়হীন এই বালিকার জন্মের কিছুদিন পরেই মায়ের আঁচলও সরে যায় জীবন থেকে। আশ্রয়স্থল ছিল এতিমখানা, কিছুদিন দত্তক পরিবারের ছায়া মিললেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ে করেন মাত্র ১৬ বছর বয়সেই। এরপর মডেল হিসেবে সামনে এলেও ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নায়াগ্রা‘ সিনেমাটির বদৌলতেই মূলত তারকা বনে যান তিনি রাতারাতি। রুপের ঝলকানি, চলন-বলন, হাসির প্রকোপে মাত হওয়া লাখ লাখ তরুণের হৃদয়ের রানী হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে তার অভিনীত বাণিজ্যিক সিনেমাগুলো তাকে এনে দেয় হলিউডে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নায়িকার তকমা।

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মেনে নিতে রাজি নয় তার ভক্তেরা। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবনে তার মৃত্যু হয়েছে তদন্তের রিপোর্টে এমন উল্লেখ থাকলেও মনরোর স্বামী পরিচয়ের দাবিদার রবার্ট স্ল্যাটজার তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন কেনেডি পরিবারকে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মনরো অনেক গোপন তথ্য জানতেন, যার কারণে তাকে হত্যা করা হয়- এমন অভিযোগও ওঠে। হয়তো তাই মনরোর মৃত্যুর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, কথিত আত্মহত্যার নোট, পুলিশের রিপোর্ট সরিয়ে ফেলে সেগুলো হারিয়ে গেছে এমনটি প্রচার করা হয়। সত্যিই তাকে এমন ভয়াবহতার শিকার হতে হয়েছিল নাকি নিজেই তার জীবনদ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন- সেই রহস্য তার মৃত্যুর সাথেই গুপ্ত হয়ে গেছে চিরকালের জন্য।

জিম মরিসন

অন্যতম জনপ্রিয় রক ব্যান্ড ‘The Doors এর ভোকালিস্ট জিম মরিসন রক সঙ্গীত জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জায়গা করে নেন সাইকাডেলিক লিরিক্সের সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে গাওয়া গানের মাধ্যমে। তার আসল নাম জেমস ডগলাস মরিসন। ১৯৪৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ফ্লোরিডায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একাধারে তিনি আমেরিকায় একজন সফল সঙ্গীতশিল্পী, লেখক, গায়ক, কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। রক সঙ্গীতের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে তাকে আজও স্মরণ করা হয়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে প্যারিসে মারা যান তিনি।

অভিনেত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে খ্যাত ফেইথফুলের সাথে সস্পর্ক ছিল মরিসনের। তিনি অভিযোগ তোলেন, তার সাবেক প্রেমিক জাঁ দে ব্রেতোয়া মরিসনের হত্যার জন্য দায়ী। জাঁ দে ব্রেতোয়া ছিলেন একজন মাদক ব্যাবসায়ী এবং মরিসন তার কাছ থেকেই মাদক সংগ্রহ করতেন বলে জানা যায়। ডাক্তারেরা তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত মদ্যপানকে উল্লেখ করলেও মরিসনের ময়নাতদন্ত কখনই হয়নি। তাই তার মৃত্যুর ভ্রমজালও অস্পষ্টই রয়ে গেছে সকলের কাছে।

জিয়া খান

২০০৭ সালে অমিতাভ বচ্চনের সাথে ‘নিঃশব্দ’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউড জগতে উদীয়মান তারকা হিসেবে পা রাখেন জিয়া খান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ক্যারিয়ারের শুরুতেই থেমে যায় তার হৃদস্পন্দন। ২০১৩ সালের ৩ জুন মুম্বাইয়ে নিজ বাসায় ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। জানা যায়ম অভিনেতা আদিত্য পাঞ্চোলির পুত্র সুরজ পাঞ্চোলির সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল জিয়ার। তার সুইসাইড নোট থেকে জানা যায়, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেই গর্ভপাত করেন তিনি। এছাড়াও সেখানে তিনি শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের কথাও উল্লেখ করেন। গলায় ফাঁসের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে প্রমাণ হলেও তার মা রাবেয়া খান দাবী করেন, জিয়া আত্মহত্যা করেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।

 

রাবেয়া পুলিশকে জানান, তিনি বাসায় ফেরার দুই ঘন্টা পূর্বেও জিয়ার সাথে নতুন সিনেমার শুটিং বিষয়ে কথা বলেন এবং জিয়াকে বেশ উত্তেজিত পান তার নতুন সিনেমার ব্যাপারে। তার পরপরই জিয়ার আত্মহত্যার বিষয়টা মেনে নিতে পারেন না তিনি। তিনি মনে করেন, জিয়াকে হত্যা করে আত্মহত্যার রূপ দেওয়া হয়। জিয়াকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করায় ও তথ্য বিকৃত করায় বিচারে ১০ জুন তার প্রেমিক সুরজ পাঞ্চোলিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর সুরজ বম্বে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন জানালে তা মঞ্জুর করা হয়। অর্থের ঝনঝনানিতে ধামাচাপা দেওয়া হত্যা নাকি নিছক জীবনের প্রতি অসন্তুষ্টিতে আত্মহত্যা তার রহস্যও হয়তো আর জানা যাবে না বাকি সবার মতো।

মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। অভাব-অনটন থাকলেও যেমন মনে সুখ থাকে না, তেমনি অবস্থা হয় যারা জীবনে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেন তাদের ক্ষেত্রেও। তারকা হওয়ার সাথে সাথে মানুষের জীবনও জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জটিল ও দুর্বোধ্য হিসেব-নিকেশের সাথে, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই রয়ে যায় সারাজীবন। তাই তাদের মৃত্যুর সাথে জড়িত বিষয়গুলো নিয়ে ভক্তরা শুধু সন্দেহ আর আবেগটাই প্রকাশ করতে পারে যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে। আর ঘটনার ভেতরের আসল ঘটনাগুলো নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকেন অতিপরিচিত এবং প্রিয় সেই মুখগুলো।