দ্রব্যমূল্য কমাতে নীতি ও ধর্মকথা

0
316

যখন সারাদেশে সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে কাজ করছে, তখন নীতিকে কোরবানী দিয়ে দুর্নীতির পাগলা ঘোড়া চালাচ্ছে সরকারেরই একটি অংশ এবং সরকার দলীয় খন্দকার মোস্তাকরা। যে কারণে নতুন নতুন সম্ভবনা বা আশার কথা না, শুনতে হচ্ছে হতাশার কথা। এমন অসংখ্য হতাশা আর বেদনাকাহিনীর একটি হলো- কুড়িগ্রামের চিলমারীতে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের লটারিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তালিকার লটারিতে মৃত ব্যক্তির নামসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। জমিজমা না থেকেও লটারিতে বিজয়ী হয়েছে অনেক কৃষক। কৃষকের বদলে সিন্ডিকেট কৌশল অবলম্বনে দালাল-ফড়িয়ারা ধান দিচ্ছেন সরকারি গুদামে। যদিও বলা হচ্ছে- চিলমারী উপজেলায় চলতি বছরে আমন ধান ২৬ টাকা কেজি দরে ৮৮১ মেট্রিক টন ধান, সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধান সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে। আর চলায় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করা হলেও তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়; উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা মৃত ব্যক্তি আ. মজিদ পিতা আকবর আলীর নাম ওঠে। থানাহাট ইউনিয়ন পরিষদের মৃত ব্যক্তির তালিকায় তার মৃত (সিরিয়াল নং-১৪৯৬)। এ ছাড়াও লটারিতে এমন কৃষকের নাম উঠেছে যার বিন্দুমাত্র জমিও নেই। আর তারই সূত্র ধরে সরকারিভাবে ধান ২৬ টাকা কেজি দরে দাম নির্ধারণ করে ক্রয় করা হলেও এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত কৃষকরা। শুধু তাই নয় সিন্ডিকেটের লোকজন কৌশলে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি এবং ব্যাংক হিসাবের চেক হাতিয়ে নিচ্ছে। ব্যাংক হিসাব না থাকা কৃষকদের ব্যাংক হিসাবও খুলে দিচ্ছেন সিন্ডিকেটরা। অথচ এরাই দাড়ি-টুপি ব্যবহার করে ধর্মকে অবমাননা করছে। যেখানে ইসলাম ধর্ম বলছে- ‘ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে, সুদকে হারাম।’ সেখানে নীতির কথা না হয় বাদই দিলাম, ধর্মকেও কলা দেখিয়ে একের পর এক ফাঁদ পাতছে ধর্মব্যবসায়ীরা। ‘বিসমিল্লাহ স্টোর’ অথচ দিচ্ছে ওজনে কম, ‘ইসলামীয় বস্ত্রালয়’ অথচ মানুষ ঠকাচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতি যখন সারাদেশে, সরকার তখন বলছে- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বন্ধে কঠোর হতে হবে। যে কারণে রমজানে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে তিন মাস আগেই সরকারের ১০ সংস্থাকে মাঠে নামানো হয়েছে। সংস্থাগুলো হল- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিরিং টিম।
তবে কেন যেন হচ্ছে- সরিষার মধ্যে যদি ভূত থাকে, তাহলে সেই সরিষায় ভূত তাড়ানো আদৌতে সম্ভব নয়। বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিরিং টিম’ হলো দুর্নীতির মূল কারখানা। সেই কারখানাকে শুদ্ধ না করে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, সফলতা আসবে না। বরং দুর্নীতি আরো বাড়বে, বাড়বে দ্রব্যমূল্য। কেননা, চরম সত্য হলো- দেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নীতি-নিয়মের মধ্যে রাখা বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদ্ধতি বা ব্যবস্থা নেই। যদিও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বেশকিছু উদ্যোগ কিংবা পদক্ষেপ প্রায় শেষপ্রান্তে এসে গ্রহণ করার ঘোষণা মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। কিন্তু পেঁয়াজের ‘বিমান ভ্রমণে’র উদ্যোগ নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়নি। আমদানি শুল্ক ও বিমানের মাশুল মাফ করে পেঁয়াজকে মহিমান্বিত করা হয়েছে, মনে হয়েছে এ কথিত কৃত্রিম সংকট অ-আমদানিকারক সিন্ডিকেটের সুযোগ সৃষ্টির কৌশল। যেমন- মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি একটি ঐতিহাসিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পেঁয়াজ, লবণ, চাল সংকট সৃষ্টিতে মনে হয় যেন এ সমস্যাকে রমজান মাসের বাইরেও সম্প্রসারণের মহড়া চলছে। রমজান মাস শুরু হওয়ার মাস দুই আগে থেকেই সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে বিশেষ কয়েকটি আইটেমের বিকল্প আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে থাকে। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও চলে সংলাপ। তারপরও রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অতীতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে শুধু বেগুনের মতো একটি আইটেমের মেগা দরবৃদ্ধির বিরুদ্ধেও কমিটি গঠন করে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুুতি নিতে হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভেজাল ও ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়ার পরও জনস্বাস্থ্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
একদিকে চাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্যতেল আর সবজি এবং অন্যদিকে ছোলা, ডাল ও পেঁয়াজের মতো আইটেমের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ হল এসব পণ্যের সরবরাহের তুলনায় অস্বাভাবিক চাহিদা বৃদ্ধি। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় কোনো কোনো ক্রেতা হয়তো এসব সামগ্রী ক্রয়ে হিমশিম খান। কিন্তু অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জনকারী পণ্যের দাম যতই হোক না কেন, তা ক্রয়ে সক্ষম। অবস্থা যদি এমন হতো যে, দাম বাড়ার কারণে সব ভোক্তা ওই পণ্য ক্রয়ে একসঙ্গে বিরত থাকতে পারেন, তাহলে সহসা সার্বিক চাহিদা কমে পচনশীল এসব পণ্যের দাম পড়ে যেত। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন এবং এর বিপণন পর্যায়ে সংশি¬ষ্ট সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এর ফলে সরবরাহ চেইনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অর্থনীতি এভাবে চলতে পারে না। চড়া মূল্যে কেনার মানুষ আছে বলেই চড়া মূল্য হাঁকা হয় আর এ পর্যায়ে স্থির কিংবা সীমিত আয়ের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বোঝার বাকি থাকে না, এমতাবস্থায় চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বিচ্যুত হয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আর সেই সূত্রতায় মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিক অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয় বিশেষ বিশেষ সময়ের প্রয়োজনে এবং সে প্রয়োজন মেটাতে হয় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। ক্রয়ের সক্ষমতা সব পর্যায়ে সমানভাবে বৃদ্ধি না পেলে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
এমতবস্থায় সরকারের একটি অংশ ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? – আমি কলা খাই না’ স্টাইলে এগিয়ে এসে বলছে- এই সেলের সদস্যরা খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি ও মোকামে অভিযান চালাবে; যাতে রমজানকে পুঁজি করে কারসাজির মাধ্যমে কেউ অতি মুনাফা লুটে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে। এ সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
কতটা কঠোর হবে বাংলাদেশ? তা গত ৪৯ বছরের ইতিহাস প্রতিনিয়ত আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়। তবু বারবার জনগন ঘুরে দাঁড়ায় আর শোনে, কে যেন বলছে- তবে এসব পদক্ষেপের পরও ভোক্তা পর্যায়ে শঙ্কা কাটছে না। তারা বলছেন, প্রতিবছরই একটি চক্র রমজানকে টার্গেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের পকেট কাটে। এবারও একই চিত্র হলে বরাবরের মতো হিমশিম খেতে হবে। তবে সঠিকভাবে তদারকি হলে সুফল আসবে। আর লোক দেখানো হলে এই তদারকি কোনো কাজে আসবে না।
তবে বরাবর আমার মনে হয়েছে, আমার বলা উচিৎ, তাই বলছি- যে পরিমাণ নিত্যপণ্য তারা সাধারণত কেনেন, রমজানেও যেন একই পরিমাণে কেনাকাটা করেন। চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য কিনে বাজারে সংকট তৈরি না করেন। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও দুর্নীতিকে ‘না’ বলে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে। যাতে ব্যবসায়ীরা পণ্য আনতে গিয়ে রাস্তায় চাঁদাবাজির শিকার না হন। এটা বন্ধ করা গেলে সারা বছরই পণ্যের দাম সহনীয় থাকবে।
আমরা দেখেছি- মাঝে মধ্যে ফরমালিনের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অভিযান চললেও পরিস্থিতির আশাজাগানিয়া কোনো উন্নতি ঘটেছে কি? ফরমালিন ব্যবহারকারীরা আপাতত পিছু হটলেও খাদ্যদ্রব্যে অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সমানে চলছে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ফরমালিন বা বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার এবং শেষমেশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের অহেতুক বৃদ্ধিকে অধিক মুনাফা অর্জনের অসৎ মানসিকতাপ্রসূত এক ধরনের ‘জুলুম’ বলে অভিহিত করা যায়। পণ্যে ভেজাল দেয়া বা ফরমালিনসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে পরিবেশ ও আর্থ-প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এটা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, সে ব্যবস্থায় দায়িত্বশীলরা এর দায় এড়াতে পারেন না। এসব অন্যায়-অনিয়মের উৎস বন্ধ না করে অন্যায়-অনিয়ম সংগঠিত হওয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা যুক্তিযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে না। যেমন- দুর্নীতি দমনের কাজ দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার পর শুরু করার মানে হল নিহত ব্যক্তির পোস্টমর্টেম করা মাত্র। ক্ষতি যা হওয়ার তা হওয়ার পর দুঃখ ও বেদনার মাত্রা নির্ণয় করা। এসবের অবসানে সমস্যার উৎস পর্যায় থেকেই জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। সমস্যার গভীরে না গিয়ে প্রতিবিধানের চেষ্টা করা হলে দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য। আর তাই চাই পদক্ষেপ-সচেনতা। তবে একথা সত্য যে, নকল, ভেজাল ও মুনাফা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুশাসনের বিষয়টি অনেকেরই অজানা, আবার যাদের জানা তারা না-জানার ভান করেন। বিষয়গুলো সবার সজ্ঞান মানসিকতায় আনা দরকার। অধিক মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, অপব্যয়, অপচয়, আত্মসাতের প্রবণতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে সব পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। মানসিকতা পরিবর্তনে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা এসব নিয়মকানুন প্রয়োগ ও প্রতিপালন পরিবীক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদেরও যথাযথ দায়িত্ব পালনে সজাগ ও সক্রিয় হতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও দেখভালের দায়িত্ব পালনকারীরা নিজেরাই যেন ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে না দাঁড়ান, সেদিকে সবার সতর্ক থাকা দরকার; দরকার এখন সরকার দুর্নীতিমুক্ত। দরকার বাংলার স্থপতি জাতির পিতার হুংকার সকল অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে। আসুন নীতির সাথে পথ চলি-কথা বলি সকল অন্যায়কে ‘না’ বলার সচেতনতা তৈরির জন্য, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো কথা ছড়িয়ে স্ব স্ব মানবিক-ধর্মীয় ও দেশপ্রেমে মজে হেগে ওঠার জন্য। যাতে আর না বাড়ে দ্রব্যমূল্য। মানুষ যেন হয় আনন্দ আর আলোর পথযাত্রী…

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি