দক্ষিণাঞ্চলে বিলুপ্তির পথে পরিবেশ বান্ধব লাঙ্গল জোয়াল দিয়ে হালচাষ

0
1180

শেখ নাদীর শাহ্:
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ,আর তাই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত দক্ষিণাঞ্চলের চিত্রও ছিল একেবারেই অভিন্ন। নদী মাতৃক পলিবাহিত উর্বর এই জনপদের মানুষদের একটা সময় সকালের শুরুটা হতো লাঙল, জোয়াল, মই আর হালের গরুর মুখ দেখে। কালের বিবর্তনে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এখন সেই জনপদের মানুষদের ঘুম ভাঙ্গে বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ট্রাক্টর এর শব্দে।
চিরচেনা বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের সন্ধান করতে গেলে কৃষির উপকরণের কথা যেমন অচীরেই চলে আসে,ঠিক তেমনি লাঙল, জোয়াল, মই আর হালের গরুর কথাও অনস্বীকার্য। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙ্গল,জোয়াল আর বাঁশের তৈরী মই।
ডিজিটাল এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা পূরণে আর দারিদ্রতার অবসান ঘটিয়ে জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভূত হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে তৈরী যান্ত্রিক হাল কলের লাঙল (ট্রাক্টর)।সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ বপন-রোপণ, ঝাড়াই-মাড়াই করার যন্ত্র। ফলে লাঙ্গল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে।
কৃষিকাজে কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল আর কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল, খিল, শক্ত দড়ি আর নিজেদের তৈরি বাঁশের মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা।কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে এ অঞ্চলের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হত, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় কম হত। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে হাল চাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখে পাট, বেত, বাঁশ অথবা লতা জাতীয় এক ধরণের গাছ দিয়ে তৈরি গোমাই, ঠুসি গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হত। আর তাড়াতাড়ি হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করতেন বাঁশের বা শক্ত কোন লাঠি দিয়ে তৈরি পাচুনি (লাঠি)।
এটা খুব বেশি দিনের কথা নয়, কয়েক বছর আগে এসব গরুর হালে লাঙ্গল-জোয়াল আর মই দেশের উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের জমিতে হরহামেশাই দেখা যেত। চাষিদের অনেকে নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষ করে পারিশ্রমিক হিসেবে অর্থ উপার্জন করতেন। তারা হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দে মনের সুখে ভাওয়াইয়া,পল্লিগীতি ও ভাটিয়ালী গান গেয়ে জমিতে চাষ দিতেন। এখন হাতে গোনা দু-একজন কৃষককে পাওয়া যায়।
ভোররাত থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পর্যন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা। চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়ি-মুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার খেয়ে নিতেন। তবে হুক্কা ও পাতা বা কাগজের তৈরি বিড়ি খাওয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। আবার একটানা হট হট, ডাই ডাই, বাঁই বাঁই, বস বস আর আর উঠ উঠ করে যখন ক্লান্তি আসত, তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠতো।এ সময় চাষিরা সকালের নাস্তার জন্য হালচাষে বিরতি রেখে জমির আইলের ওপর বসতেন। তাদের নাস্তার ধরনটাও ছিল ঐতিহ্যবাহী-এক থালা পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ, সরিষার খাঁটি তেল আর আলু ভর্তা। এসব তো গেল শুকনা মৌসুমে হালচাষের কথা। বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেলে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন। হাল চাষিদের সঙ্গে আরো যোগ দিতেন ধানের চারা রোপনের লোকজন। সকলের অংশ গ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো কৃষাণ। কৃষাণে অংশ নেওয়া কৃষাণদের জন্য জমিওয়ালা গৃহস্থ বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে ভোজ করাতেন।
কিন্তু এখন সময়ের পরিবর্তনে দক্ষিণাঞ্চল থেকে গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙ্গল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কৃষাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

বিলুপ্তির কারণ:
অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘের গুলোতে এখন আর ধান রোপন করা হয় না। লবণ পানির কারণে বোরো আবাদ নেই বললে চলে।গরুর পর্যাপ্ত খাবারের অভাব। গরুর বিচরনের তেমন কোন জায়গা নেই। তাছাড়া বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা পূরনে জীবন যাত্রার মানউন্নয়নে আবির্ভূত হয়েছে যান্ত্রিক হাল যেমন, কলের লাঙল,( ট্রাক্টর) সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ বপন-রোপণ, ঝাড়াই-মাড়াই করার যন্ত্র। আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র দু একজন লোক প্রয়োজন। যার ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ঐ সব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।আগামী প্রজন্ম হয়ত বিশ্বাসই করবে না এভাবে অতীতে চাষ কাজ করা হত।তবে বর্তমানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষি ক্ষেত্রে বহুলাংশে সাফল্য নিয়ে এসেছে। পূর্বে যারা গরু দিয়ে হাল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো কালক্রমে জীবিকার তাগিদে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। ঐতিহ্যের লালন করতেই এখনো গ্রামের অনেক কৃষক জমি চাষের জন্য গরু দিয়ে হাল চাষের পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেছেন। তবে যান্ত্রিকতার দাপটে ঐতিহ্যের বাহক এসকল কৃষি উপকরণ কতদিন কৃষকের ঘরে টিকে থাকবে তা কেবল ভবিষ্যতই বলতে পারে।