জীবন যেখানে সমস্যা সংকুল

0
570

আজিজুর রহমান, দাকোপ থেকে ফিরে :
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার দেড় মাস পার হতে চললেও খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় দাকোপ উপজেলার হাজারো মানুষ এখনও পুরো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। অনেকে এখনও একপ্রকার আশ্রয়হীন অবস্থায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যে জবুথবু হয়ে কোনো রকম দিন পার করছেন। আর বছরের একমাত্র ফসলের ক্ষতিতে অনেকে দিশেহারা।

সুন্দরবন সংলগ্ন এই উপজেলার সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের মানুষের রাস্তাঘাট, সুপেয় পানি ও কর্মসংস্থানের অভাবসহ নানান সমস্যার শেষ নেই। সবশেষ বুলবুলের আগে গত একযুগে ওই উপজেলার মানুষ সিডর, মহাসেন, আইলা ও ফণীর মত ঝড়ের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে। একেকটি ঝড় গেছে, সংগ্রামী মানুষগুলো আবারও গুছিয়ে নিতে নিতে আরেকটি ঝড় এসে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

সরকার ওই এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডারে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণ করছে। সেই বাঁধের কাজ কবে শেষ হবে তাও জানা নেই মানুষের। বাঁধ নির্মাণের কাজ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এদিকে তীর সংরক্ষণ না করে শত শত কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ করা হলেও নতুন বাঁধ আবার ভাঙবে বলে মনে করছে এলাকাবাসি।

সোমবার (২৭ জানুয়ারি) ওই এলাকায় গেলে স্থানীয় লোকজন জানালেন, নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা, সুপেয় পানির সংকটের কথা, চিকিৎসার অভাব, কাজ না পাওয়া, এলাকা ছেড়ে যাওয়া এবং বেড়িবাঁধ নিয়ে তাদের আতঙ্কের কথা।

বিভিন্ন সময়ে ঝড়ে দাকোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির খুলনাটাইমসকে বলেন, আইলার পর পুরো এলাকা প্রায় আড়াই বছর পানিতে ডুবে ছিল। এখনও বেশ কয়েকশ একর জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ ধান চাষ করতে পারে না। হাজারখানেক পরিবার ঘরে ফিরতে পারেনি। আবার বুলবুলের কারণে এলাকায় যে পরিমাণ ধান হওয়ার কথা তার এক চতুর্থাংশও হবে না। যাতায়াত, পানির সমস্যা ও কর্মসংস্থানের অভাব এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ কাজের সন্ধানে বাইরে থাকছে। আইলার পরে স্থায়ীভাবে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে।


গুণারী গ্রামের বাসিন্দা মনীন্দ্র নাথের সঙ্গে দেখা হয় উপজেলার কালিনগর বাজার থেকে গুনারী যাওয়ার পথে মাটির রাস্তায়। খুলনা শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দক্ষিণে ওই জায়গা। তিনি বললেন, আইলা কবলিত এই এলাকায় এক ফুট জায়গাতেও পিচঢালা রাস্তা নেই। খুবই কম সংখ্যক ইটের রাস্তা। সব রাস্তাই কাঁচা, এবড়োথেবড়ো গ্রামীণ মেঠোপথ। এই কাঁচা রাস্তা দিয়েই পায়ে হেঁটে মানুষকে চলাচল করতে হয়। বর্ষাকালে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়। এই সময় মানুষ আর চলতে পারে না। ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারে না। জেলা শহর খুলনায় যেতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লাগে। মাছ পরিবহনের ট্রলার যোগে খুলনা যাওয়ার অন্যতম ভরসা।

উপজেলার নলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা বেল্লাল হোসেন যাতায়াতের সমস্যা তুলে ধরে বললেন, গ্রাম থেকে উপজেলা সদর পর্যন্ত যেতে জনপ্রতি খরচ পড়ে ৩০০ টাকার বেশি। অসুস্থ রোগি নিয়ে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়। আশপাশে কোনো হাসপাতাল, ডাক্তার না থাকায় উপজেলা হাসপাতালে নিতে নিতে পথেই অনেক রোগী মারা যান।

সুতারখালী গ্রামের বাসিন্দা মো. ওসমান গণি বলেন, এলাকায় ভালো কোনো রাস্তাঘাট নেই। কোথাও একটা ভ্যানও চলে না। উপজেলা সদরে যেতে একদিন আগেই মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হয়। নদীপথের ট্রলারই একমাত্র ভরসা। তারপরও সকাল নয়টার পর আর ট্রলার যায় না। খুলনা যেতে হলেও সেই ট্রলার। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা পরিত্যক্ত কোনো জনপদের বাসিন্দা।

কামারখোলা গ্রামের বাসিন্দা বিধবা আমিরন বেগম বলেন, আইলায় ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়াতে রাস্তায় আশ্রয় নেই। ভিটাবাড়ি নদীতে ভেসে যাওয়ায় সেই থেকে রাস্তার পাশে অন্যের জায়গায় একটি ঘর তুলে কোনোমতে বাস করতাম। বুলবুল তা আর থাকতে দিল না। ঝড়ে ঘর ভাঙলেও কোনো প্রকার সহযোগিতা পায়নি। এখন কোনোমতে ঝুপড়ি করে শীতের রাতে সন্তান নিয়ে জবুথবুভাবে থাকছি।

সুতারখালী ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ননীগোপাল বৈদ্য বললেন, ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় নোনাপানির চিংড়ি চাষের পাশাপাশি আমন ধান হত। পরিবেশ বিপর্যয়সহ বেশ কিছু কারণে চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমনের উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। তবে লবণাক্ত জমিতে একফসলি থেকে কিভাবে বহুফসলী করা যায় তা নিয়ে চোখে পড়ার মতো কোনো কাজই হচ্ছে না।

সুতারখালী গ্রামের কৃষক মো. আল-আমিন গাজী বলেন, গ্রামে কাজ নেই। এবার বুলবুলের জন্য ধানও হয়নি। যা হয়েছে অধিকাংশ নারীরাই কাটছে। পুরুষরা বাইরে কাজ করতে গেছে। একটাই ফসল মানুষ এবার কি খেয়ে বাঁচবে।

কামারখোলা ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামের পল্লী চিকিৎসক কৃষ্ণপদ বিশ্বাস বললেন, কেউ যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু বড় ধরণের সমস্যা হলে চিকিৎসা দেওয়া আর সম্ভব হয় না। ফলে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে দক্ষ চিকিৎসক না থাকায় সেবা পেতে বাধাগ্রস্থ্য হচ্ছে।

দাকোপ উপজেলার মানুষের যে সংকটগুলো এখনও অনেক বেশি ভোগায় তার মধ্যে অন্যতম সুপেয় পানি। ওই জনপদের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুরের পানি ও বৃষ্টির পানির ওপর ভরসা করত। আইলার পরপরই এলাকায় পানির সমস্যা তীব্র হয়। আইলায় লোনাপানির চাপে ভেসে যায় বহু পুকুর। ১০ বছরেও বেশির ভাগেরই সংস্কার হয়নি। আবার আইলার সময় সাধারণের পানীয় জলের সংকট নিরসনে বেশ কিছু পুকুর খনন করে। সেসব পুকুরের বেশিরভাগই এখন জনসাধারনের আয়ত্বে নেই। যাদের জমিতে পুকুর কাটা হয়েছিল তারাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন।

গুনারী গ্রামের ওয়াস কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম মীর বললেন, আমাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা পানীয় জলের। নলকূপে সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে কাজ চলে। সেই পানি ফুরিয়ে গেলে বাধ্য হয়ে পুকুরের পানিতেই ভরসা। পরিস্থিতির বেশি অবনতি ঘটেছে আইলার পর। সেই পরিস্থিতি এখনও খুব একটা পাল্টায়নি।

কালাবগী গ্রামের পুতুল রাণী মণ্ডল বলেন, তাদের পানি আনতে হয় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের রামনগর গ্রামের সরকারি পুকুর থেকে। নৌকায় করে তাঁরা সেই পানি আনেন।

কালাবগী ঝুলন্তপাড়ায় শিবসার চরে টংঘরে বাস করেন মোক্তার হোসেন। তিনি বললেন, শিবসা নদী পাড়ি দিয়ে গড়ইখালি বাজারের একটি পুকুর থেকে পানি ভরে গ্রামে আনেন কয়েকজন। অনেকেই এক টাকা লিটার দরে সেই পুকুরের পানি কেনেন। আবার অনেকে খুলনা থেকে ড্রামে করে পানি কিনে আনেন। মোক্তারের স্ত্রী আম্বিয়া বেগম বলেন, বৃষ্টির পানি যা ধরে রেখেছিলাম তা কয়েকদিনে মধ্যে শেষ হবে। আর এখন রান্নার জন্য আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনি সে পানিও পুরো মিষ্টি না।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে, দাকোপের প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায় না। এরমধ্যে সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পায় না। উপজেলার কোনো ইউনিয়নের নলকূপই কার্যকর নয়। পুকুরের পানি ও বৃষ্টির পানি প্রায় দুই লাখ মানুষের ভরসা। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা টাকা দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন। সরকার ও কিছু এনজিও এখানে রিজার্ভ ট্যাংক সরবরাহ, পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ করেছে। কিন্তু সবই প্রয়োজনের তুলনায় কম। পুকুর খনন, পূণঃখনন এবং বৃষ্টির পানি দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখাটাই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান।

পানির সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক খুলনাটাইমসকে বলেন, দাকোপ এলাকায় সুপেয় পানির সবচেয়ে বড় সমস্যা। নলকূপ অকেজো থাকায় প্রতিটি ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য কম দামে প্লাস্টিকের ট্যাংক দিচ্ছে সরকার। বিভিন্ন এনজিও তাদের সুবিধাভোগীদের কখনও বিনামূল্যে আবার কখনও কিস্তিতে ট্যাংক বিক্রি করছে। এলাকায় বেশ কিছু পুকুর খননের কাজ চলছে। পানির জন্য বড় প্রকল্প আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।