খুলনা শহর থেকে গ্রামে চলছে অনলাইন ক্যাসিনো কারবার

0
866

সুমন আশিক: প্রয়োজন হয় না ক্লাব। লাগে না সাজসজ্জা। আয়োজন নেই নিরাপত্তার। নেই খেলার সরঞ্জামও। দরকার হয় না নির্দিষ্ট সময়। ২৪ ঘণ্টাই চলে জুয়ার কারবার। যেখানে-সেখানে বসেই অনলাইনে খেলা যায় বেটিং বা গ্যাম্বলিং নামের এই জুয়া। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গোপন লিংকে চলা এই জুয়া অনলাইন ক্যাসিনো নামে পরিচিত। দেশে অবৈধ ক্যাসিনো কারবারের বিরুদ্ধে অভিযানের মধ্যে সামনে এসেছে গোপনে চলা এই রমরমা কারবার। বেট- ৩৬৫, টি-২১ এবং পি২৪ নামের অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইট। সূত্র জানিয়েছে, পাঁচটি দেশের নিবন্ধিত বেটিং সাইটগুলোতে দেশ থেকে অনলাইন জুয়া খেলা হচ্ছে। ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এবং ডিলারদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চিপস বা কয়েন কিনে স্মার্ট মোবাইল ফোন দিয়েই এই জুয়া খেলা চলছে। বাস্তবে ফুটবল-ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার সময় বাজি এবং ওই সব খেলার আদলেই হচ্ছে অনলাইন জুয়ার কারবার। জুয়ায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগই শিক্ষার্থী বা বয়সে তরুণ। নেশায় পড়ে অনেকে হচ্ছে নিঃস্ব। ঢাকার সেলিম প্রধানের মত খুলনায়ও এমন চক্রের তথ্য মিলেছে। খুলনায় বর্তমানে অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। করেছেন স্থান পরিবর্তন। পালটিয়েছে কাজের ধরন। কিন্তু তাদের কাজ থেমে নেই, চলছে হরদম বহাল তবিয়তে। সমাজে তারা অনলাইন আউটসোর্সিং বা ফিল্যান্সার হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রকৃত পক্ষে তারা ব্রকার অনলাইন ক্যাসিনোর ব্রকার হিসেবে কাজ করে। এই চক্র মূলত সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকে একাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে চিপস ভাঙ্গানো পর্যন্ত। যার কারনে খুব সহজেই একজন মানুষ অতি লাভের আশায় অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এমন একাধিক চক্র খুলনায় কাজ করছে বলে সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম বিএল কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার শাকিল। দৌলতপুরস্থ একটি ম্যাচে থেকে পরিচালনা করে আসছে এই অনলাইন ক্যাসিনো বোর্ড। ঘনিষ্ঠজনদের যুক্ত করে এই কারবার চালায় সে। তবে এক ঘটনায় বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি লাপাত্তা হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এই শাকিল আছে যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভরত ভায়না গ্রামে। বিএল কলেজের কতিপয় শিক্ষার্থী এবং ৩/৪ নিকটজন নিয়ে সেখানে ফের পুরোদমে শুরু করেছে এই অনলাইনে জুয়ার ব্যবসা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এর এক সাবেক নেতার ছত্রছায়ায়। অপরদিকে খুলনা মহানগরীর গল্লামারী এলাকায় হাফিজ নামের একজনের নাম উঠে আসছে এই অনলাইন ক্যাসিনো কান্ডে। প্রসঙ্গত, ‘‘অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং/ডিলিং এর মাধ্যমে মুনাফার প্রলোভন বৈদাশিক মুদ্রার অবৈধ ক্রয়-বিক্রয় থেকে বিরত থাকুন’’ শিরোনামে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেখানে বলা হয়, সম্প্রতি বৈদাশিক মুদ্রার অবৈধ অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং/ডিলিং এর মাধ্যমে মুনাফার প্রলোভন দেখানো কিছু প্রচারণা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুক এর মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, এমনকি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণেও লক্ষ করা যাচ্ছে। ফরেইন একচেঞ্জ রেজুলেশন আইন, ১৯৪৭ মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সধারী অনুমোদিত ডিলার/মানি চেঞ্জার ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অনলাইন বা অন্যান্য মাধ্যমে বৈদাশিক মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় বেআইনি ও দন্ডযোগ্য অপরাধ। এ প্রেক্ষিতে বৈদাশিক মুদ্রার এ ধরণের অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ের প্ররোচণামূলক বিজ্ঞপ্তি দ্বারা আকৃষ্ট না হবার জন্য এবং বিজ্ঞাপন প্রচারে সহায়ক ভূমিকা না নেবার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘আমাদের একটি সাইবার মনিটরিং সেল রয়েছে। সেই সেলে আমরা দেখতে পাই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিংয়ে নিয়োজিত রয়েছে। এর সূত্র ধরে আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই অনলাইন ক্যাসিনো বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, স্থানীয়ভাবে যে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সংস্থাগুলো আছে তাদের সাহায্যে খুব স্বল্পমূল্যে চক্রগুলো জুয়ার চিপস সরবরাহ করছে। সহজ ও খেলা নিয়ে হওয়ায় তরুণরা বেটিং গেমের নামে জুয়ায় ঝুঁকে পড়ছে। এর মূল ডেভেলপার হচ্ছে চীন, হংকং, কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ইউক্রেনের মতো কিছু দেশ। এসবের প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে বেটিং বা জুয়ার কারবারে বিদেশে অর্থপাচারের পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে খুলনায় বসে অবৈধভাবে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়া পরিচালনা করছে। তারা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছ থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছি। অনলাইনে বেটিং বা জুয়ার কারবারে বিদেশে অর্থপাচারের পাশাপাশি সাইবার সিকিউরিটিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
উল্লেখ, সরকার সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প থেকে ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে এ প্রকল্প থেকে প্রায় আড়াই হাজার গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করে দেওয়ার পরও অনলাইনে জুয়া খেলা যে বন্ধ হয়নি। অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইটগুলোর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থেকেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শনাক্ত করছে। ইতোমধ্যে খুলনা ও আশপাশের জেলায় সক্রিয় অনলাইন ক্যাসিনো, ফুটবল-ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলার সময় বাজি ধরা এবং ওই সব খেলার আদলেই যেসব অনলাইন জুয়ার কারবারী শুণ্য থেকে কোটিপতি হয়েছে তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারী শুরু করেছে। অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ায় হোতাসহ তাদের শেল্টার দাতাদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে এবং জঙ্গী সংগঠনের অর্থায়নে এই অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ায় হোতাদের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাদেরই গ্রেফতার করা হবে তাদের সহযোগিদের এই সাইবার ক্রাইমের আইনের আওতায় আনা হবে ।