অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক প্রকল্প খরগোশ পালনঃ খরগোশ উৎপাদনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল

0
2372

খুলনাটাইমস ডেস্কঃ খোরগোশ পালন করে পরিবার নিজেদের দিনবদলের চেষ্টায় সফল হয়েছেন বেকার যুবত যুবতীরা । খরগোশ পালন উৎপাদনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে অনেকেই। ২০০৮ সালে নেত্রকোনা জেলার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির ইনকাম অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি ফর আলট্রাপোর-ইফসাস প্রকল্প নামে গুচ্ছগ্রামে খরগোশ পালনের পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়। এ পাইলট প্রকল্পে স্থানীয় আদিবাসী পরিবারগুলো তিনটি সমিতির মাধ্যমে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। সমিতিগুলো হচ্ছে_ সিলভিয়া, পাহাড়িকা ও নিথুরিয়া। সমিতি থেকে খরগোশ পালনের জন্য প্রতিটি পরিবারকে সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ পেয়ে গুচ্ছ গ্রামের সুরনা হাজং, পুষ্পবালা হাজং, গীতা হাজং, চপলা রিছিল, কনকিনা চাম্বু গং, মায়া রানী হাজং, রিজিলা হাজংসহ কয়েকটি দুই পদ্ধতিতে খরগোশ পালন শুর করেন। তারা জানান, ৪ ফুট উচ্চতা এবং ৭ ফুট চওড়া কাঠের ঘর বানিয়ে চারদিকে নেট দিয়ে খরগোশ পালন করা হয়। জন্মের দিন থেকে খরগোশ প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৬ মাস সময় লাগে। এরপর প্রতি মাসে মাদি খরগোশ ৫-৬টি করে বাচ্চা দেয়। কোনো কোনো খরগোশ সর্বোচ্চ ৯টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। খরগোশের মাংস অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। সিলভিয়া সমিতির সদস্য কনকিনা চাম্বু গং বলেন, খরগোশ পালন ও তা বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে তার পরিবারে। শেরপুরের নকলা উপজেলার বেকার যুবকরা শখের বসে খরগোশ পালন করে  আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। উপজেলার ভূরদী গ্রামের মনির, ডাকাতিয়া কান্দার মোশারফ, ইশিবপুরের আদেল ও হুমায়ুন কবির বর্ষা এবং কাশিগঞ্জের সুরুজ আলীর মতো অনেকেই খরগোশ পালন করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। বাড়িতে খরগোশ পালন করে এসব বেকার যুবক শুধু সফলই হননি, অন্যদেরও পথ দেখাচ্ছেন। ফলে দিন দিন খরগোশ পালনের আগ্রহ বেড়েছে স্থানীয় বেকার যুবকদের মাঝে। খরগোশ পালনে খরচের তুলনায় আট দিক দিয়ে গড়ে লাভ হয় প্রায় সাতগুণ।
স্থানীয়রা জানান, খরগোশের মাংস সুস্বাদু, পুষ্টিগুণে ভরা। এ প্রাণীটি পালনে আলাদা আবাসস্থল নির্মাণ করতে হয় না, শ্রমও কম দিতে হয়। খরগোশ সব ধরনের খাবার খায় তাই আলাদাভাবে খাবার কিনতে হয় না। রোগব্যাধি সাধারণত কম হওয়ায় খরগোশ পালনে ওষুধ বাবদ ব্যয় নেই। সবদিক দিয়ে খরগোশ পালনে খরচের তুলনায় গড়ে লাভ হয় প্রায় সাত গুণ। তাছাড়া এ প্রাণীটি আমিষের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

খরগোশ পালনে করোনীয়ঃ
খরগোশ পালনঅত্যন্ত নিরীহ একটি প্রাণী। দুই থেকে তিন কেজি ওজনসম্পন্ন অধিক উৎপাদনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল খরগোশ পালন বেশ লাভজনক। অল্প পুঁজি ও পরিশ্রমে খরগোশ পালন করা যায়। খরগোশের মাংস অধিক পুষ্টিমানসম্পন্ন ও চামড়া মূল্যবান পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শিশুদের কাছে খরগোশ খুবই পছন্দের একটি পোষা প্রাণী। বেকার তরুণ-তরুণী অল্প জায়গা ও মূলধনে এ খাত থেকে ভালো টাকা উপার্জন করতে পারেন।
খরগোশ অত্যন্ত নিরীহ ও শান্ত প্রাণী। এটি পালন বেশ সহজ ও লাভজনক। কম জায়গা ও কম মূলধনের জন্য এটি হতে পারে একটি লাভজনক ব্যবসা। ছয় মাস বয়সে খরগোশ বাচ্চা দেওয়া শুরু করে। প্রতিবারে এরা ২ থেকে ৮টি বাচ্চা দেয় এবং বছরে ৪ থেকে ৬ বার বাচ্চা দেয়। তিন মাস বয়সে একটি খরগোশের ওজন ২ থেকে আড়াই কেজি হয়ে থাকে। এটি একটি উৎপাদনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল প্রাণী। খরগোশ তৃণভোজী প্রাণী। এদের খাদ্য সহজলভ্য। অল্প পরিমাণের খাদ্য এদের চাহিদা পূরণ করে। খরগোশের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এদের গোশতে চর্বি ও কোলেস্টরলের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশ কম। খরগোশের মাংসে অন্য মাংসের চেয়ে খাদ্যমান অনেক বেশি।

খরগোশ পালনে প্রথমেই জেনে নেয়া প্রয়োজন এটি পালনের করণীয় সম্পর্কে। এদের নিরাপদে বাসস্থান, খাদ্য, প্রজনন প্রক্রিয়া, রোগব্যাধি সম্পর্কে ধারণা নিয়েই খরগোশ পালনে অগ্রসর হওয়া ভালো। খরগোশ পালন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া খরগোশ পালন সম্পর্কে বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছে। প্রয়োজনে বইগুলো সংগ্রহ করলে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।

একজোড়া পূর্ণবয়স্ক খরগোশ কেনা যাবে ৪০০-১০০০ টাকায়। প্রতি মাসে এরা বাচ্চা দিতে পারে। তবে বছরে ৮ বারের বেশি বাচ্চা নেওয়া উচিত নয়। প্রতিবার এরা ২ থেকে ৮টি বাচ্চা দেয়। এই হিসেবে বছরে একজোড়া খরগোশ থেকে গড়ে ৩২ থেকে ৪০টি খরগোশ হতে পারে। পাশাপাশি ৩ মাস অন্তর অন্তর এরা পূর্ণবয়স্ক হয়ে পুনরায় এদের থেকেই আবার বাচ্চা জন্ম নেয় এর ফলে পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা রাখতে হয়। গড় হিসেবে দেখা গেছে এক হাজার টাকার একজোড়া ছয়মাস বয়সী বাচ্চাকিনে বছরে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। মাংস হিসেবে এটি যথেষ্ট চাহিদাসম্পন্ন। বিদেশে এর মাংস ও চামড়া রপ্তানি হয়।

খরগোশদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাপনায় যেসব বিষয় মনে রাখা দরকার খরগোশের দাঁত ক্রমাগতই বাড়ে। তাই শুধুমাত্র ঘনীভূত খাবার দিয়ে খরগোশ পালন অসম্ভব।খাওয়ানোর সময় খুব সচেতনভাবে মানা উচিত্‌, কারণ দেরী হলে ওরা চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং তাতে ওদের শরীরের ওজন কমে।

গরমের দরুন খরগোশরা দিনের বেলায় খাবার নেয় না। কিন্তু রাত্রিবেলা ওরা সক্রিয় থাকে। তাই রাত্রিবেলা দেওয়া সবুজ খাবার ওরা নষ্ট না করেই খেয়ে নেয়। এই জন্য ঘনীভূত খাদ্য সক্কালবেলা দেওয়া উচিত্‌।

ঘনীভূত খাদ্য পেলেটের আকারে দেওয়া যায়। যদি পেলেট খাবার পাওয়া না যায়, তবে ঘনীভূত খাদ্য জলের সাথে মিলিয়ে ছোট ছোট বলের আকার করে দেওয়া যায়।এক কেজি ওজনের একটি খরগোশকে দিনে ৪০গ্রাম ঘনীভূত খাদ্য এবং ৪০গ্রাম সবুজ খাদ্য দেওয়া উচিত্‌।খরগোশ সবসময় তাজা সবুজ খাদ্য খায়। সবুজ খাদ্য কখনও খাঁচার মেঝেতে না দিয়ে পাশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত্‌।দিনের সবসময় খরগোশকে তাজা ও পরিষ্কার জল দেওয়া উচিৎ।

কি কি করবেন

বাচ্চা জন্ম দেয়ার জন্য একটি ছোট নেস্ট বক্স অথবা কিছু পরিষ্কার খড়কুটো দিন।বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য পরিবেশ শান্ত ও পরিছন্ন রাখুন।
জন্মের পর কোন মরা বাচ্চা থাকলে তা সরিয়ে নিন।জন্মের পর ১ মাস বাচ্চাকে মায়ের সাথে থাকতে দিন।১ মাস পর মা থেকে আলাদা করে একসাথে রেখে আরও ২ মাস পালার পর খাওয়ার উপযুক্ত হবে।বাচ্চার গায়ে হাত দিয়ে আদর করবেন না। কারণ এতে বাচ্চার শরীরে অন্য গন্ধ হয় এবং মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দিতে পারে।খরগোশের ঘর, খাঁচা, খাদ্য ও জলের পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করুন।খাঁচা, নেস্ট বক্স পরিষ্কার জলে ধুয়ে অনেকক্ষণ রোদে রাখুন।পরিষ্কার খাবার ও বিশুদ্ধ জল দিন।পিঁপড়ে, ইঁদুর, ছুঁচো, শিয়াল ইত্যাদির আক্রমণ থেকে খরগোশকে রক্ষা করার জন্যে খাঁচাতে মাঝে মাঝেই নজর দিন।

খরগোশের বাসস্থান

অল্প জায়গায় খাঁচায় খরগোশ পালন করতে হবে।নিরিবিলি, পরিষ্কার-পরিছন্ন ও শান্ত পরিবেশ বজায় রাখুন।একটি বড় খাঁচায় ভাগ করে কয়েকটি খরগোশ রাখুন।কয়েকটি স্ত্রী খরগোশ একসাথে রাখা যায়। তবে একাধিক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ একসাথে রাখা ঠিক না কারণ এরা মারামারি করে।
৩ মাস বয়সের পর স্ত্রী ও পুরুষ খরগোশ আলাদা আলাদা রাখুন। শুধু প্রজননের জন্যে পুরুষ খরগোশ ও স্ত্রী খরগোশ ১০-১৫ মিনিট রাখুন।খরগোশের খাঁচা- বাঁশ, কাঠ ও তারের নেট দিয়ে তৈরি করে নিন।খাঁচা তৈরি

খাঁচা তৈরির জিনিসপত্র শক্ত টেকসই ও সহজে পরিষ্কার-পরিছন্নযোগ্য হতে হবে।খাঁচা তৈরির জন্য স্থানীয় কমদামি জিনিসপত্র ব্যবহার করতে হবে।খাঁচা হালকা রাখতে হবে, যাতে সহজে বহন করা যায়।খাঁচায় খাবার ও জল রাখার সুব্যবস্থা করতে হবে।খাঁচার ভিতর খরগোশ যেন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।খাঁচা থেকে খরগোশ যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।খাঁচার মাপখরগোশের ওজন যত কেজি হবে খাঁচার তলদেশও তত বর্গফুট হতে হবে।৬টি খরগোশের জন্য খাঁচার মাপ নিম্নরূপ :কাঠামো (ফ্রেম) লম্বা ৯ হাতX ১/৫ হাত থেকে ২ হাত, মেঝে ১৬ কেজি তারের জাল ৯ হাতX ১/৫ হাত।দেয়াল:পাতলা ও শক্ত কাঠের তক্তা দিয়ে করতে হবে।

ছাদ

তারের জাল দিয়ে তৈরি করতে হবে। স্ত্রী খরগোশের খাঁচায় একটি ছোট নেট বক্স দিতে হবে। এবং এর মাপ হবে ১ফুটX১ফুট, উচ্চ ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি হবে। বাক্সের একপাশ এবং উপরের অংশ খোলা রাখতে হবে।

খরগোশের খাবার

কচি ঘাস, লতা-পাতা, শস্য দানা, গাজর, মূলা, শশা, মিষ্টি আলু, খড়কুটো, তরকারির ফেলনা অংশ, গম, কুড়া, ভুসি, খৈল, সয়াবিন, দুধ, পাউরুটি, ছোলা ইত্যাদি খরগোশের খাবার। ঘাস, শাক ইত্যাদি সব সময় শুকনা বা ঝকঝকে অবস্থায় দিতে হবে। ভেজানো গম বা ছোলা অল্প সিদ্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। এর সাথে ভুসি মিশিয়ে দিলে আরো ভালো হয়।