করোনায় রফতানি বন্ধ: সম্ভাবনাময় কাঁকড়া শিল্পে চরম বিপর্যয়

0
499

বেকার হচ্ছেন শিল্প সংশ্লিষ্ট লক্ষাধিক মানুষ

শেখ নাদীর শাহ্ ::


করোনার নেতিবচক প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম খাত কাঁকড়া শিল্পে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বন্ধ হতে বসেছে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার সহ¯্রাধিক কাঁকড়া খামার। করোনাকাল্পে রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিল্পের সাথে জড়িত খামারী,ব্যবসায়ীসহ হাজার হাজার শ্রমিকরা রীতিমত বেসামাল হয়ে পড়েছেন। রেকর্ড পরিমাণ লোকসান কাটিয়ে খামারগুলোকে কোন রকম টিকিয়ে রাখাও তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে বিকল্প আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের সর্বাতœক সহযোগিতা কামনা করেছেন তার।
দীর্ঘ করোনাকালে অব্যাহত লোকসানের মুখে ইতোমধ্যে ছোট-বড় বহু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি বদলে লোকসান কাটিয়ে উঠতে অনেকেই কোন রকম টিকে থাকলেও অতিদ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির উপর নির্ভর করে কাঁকড়ার স্থানীয় বাজার দর। গত বছরের মার্চে চীনে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হলে মূর্তেই দরপতন ঘটে কাঁকড়ার। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অব্যাহত লোকসানের মুখে চলতি বছর অধিকাংশ খামারে বন্ধ হতে পারে সম্ভাবনাময় কাঁকড়া চাষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অধিকাংশ খামারীরা বিভিন্ন এনজিও অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খামার পরিচালনা করে থাকেন। করোনা কালে রফতানি বন্ধ থাকায় পাওনাদারদের ঋণ পরিশোধে তাগিদ এড়াতে অনেকেই খামার টিকিয়ে রেখেছেন। খামার বন্ধ করলে দেনাদারদের চাপ বাড়তে পারে আবার খামার টিকিয়ে রাখতে লোকসানের পাশাপাশি ঋণের পাল্লা ভারী হচ্ছে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
এদিকে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৬৩ জন কাঁকড়াচাষীকে সহায়তার ঘোষণা এসেছে। তবে খামারিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারির তুলনায় সরকারের এ সহায়তা নিতান্তই অপ্রতুল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসেবে দুই সহ¯্রাধীক কাঁকড়া খামার রয়েছে। ওসব খামারের সঙ্গে যুক্ত চাষীর সংখ্যা ৫ সহস্রাধিক। রফতানি বন্ধ থাকায় খামারে চাষ করা অধিকাংশ কাঁকড়াই মরে যাচ্ছে। সেজন্য খামারিদের চরম লোকসানে পড়তে হচ্ছে। সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরেই নানা প্রকার রোগবালাইয়ের কারণে চিংড়ি চাষে তেমন লাভ না হওয়ায় অনেক খামারিই কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়ে। তাতে লাভও ভালো হতে থাকে। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়।
রফতানি বন্ধে দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মতো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে পুকুরেই মরে যায় কাঁকড়া। এরপর করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গত অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে নিজেদের ঋণের জালে আটকে অনেক খামারি ফের শুরু করে কাঁকড়া চাষ। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে কাঁকড়া বিক্রি করে খামারিদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। আর বর্তমানে কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও খামারিরা স্বাভাবিক ঋণের দায়ে ঘরে থাকতে পারছে না।
আর যারা লোকসান টেনেও কাঁকড়া চাষ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের অবস্থাও বেসামাল। এ অবস্থায় চীনে সরাসরি কাঁকড়া রফতানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিনা সুদে ঋণ দিয়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন চাষীরা।
পাইকগাছার কপিলমুনির কাশিমনগর গ্রামের শেখ নজরুল ইসলাম, শেখ জাহাঙ্গীর আলম বলছিলেন, রফতানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত পাঁচটি গ্রেডে বিক্রি হয়। বর্তমানে গ্রেড প্রতি কেজিতে ৩ শ’ থেকে ৪ শ’ টাকা কমেছে। তারা জানায়, করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে ২০০ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল ১৫ শ থেকে ১৭ শ টাকা, ওই কাঁকড়া বর্তমানে ৮০০ টাকা। ১৮০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ১ হাজার টাকা, তা বর্তমানে ৬০০ টাকা। ১৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা ৪০০ টাকা। ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৬০০ টাকা কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এমন দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষীদের যেমন খরচ ওঠে না, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও লোকসানে পড়তে হয়।
এদিকে এ প্রসঙ্গে কয়রা উপজেলা কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সদস্য রবি কয়াল জানান, সারা দেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত।
পাইকগাছার কাঁকড়া রফতানি কারক শান্তা ফিসের স্বত্ত্বাধিকারী শেখ আনারুল ইসলাম জানান, করোনায় কাঁকড়া শিল্প তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। লোকসানের মুখে অধিকাংশ খামারে কাঁকড়া উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। যারা কোনমতে টিকে রয়েছেন তারাও বন্ধের পথ খুঁজছেন। উৎপাদন নাহলে তাদেরও ব্যবসা থাকবেনা। তিনি জানান, শিল্পের সাথে জড়িত অন্তত ২ লক্ষাধিক মানুষ কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকেই আবার পেশা বদলের চিন্তা করছেন। এমনটি হলে সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি সরকারও প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হবেন।
পাইকগাছা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার পবিত্র কুমার দাশ জানান, আবহাওয়ার অনুকুল পরিবেশে পাইকগাছায় লোনা পানির চিংড়ি ঘেরের বাইরেও আলাদাভাবে কাঁকড়ার চাষ হয়। এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁকড়ার মান অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভাল। প্রতি বছর কাঁকড়া রফতানি করে এ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে করোনার বিরুপ প্রভাবে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকেই খামার বন্ধ করে পেশা বদলের চিন্তা ভাবনা করছে।