হিটলার, ইয়াবা এবং ক্রসফায়ার

0
1304

অনলাইন ডেস্ক : ‘নাজি স্পিড’ বা ইয়াবার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সাথে যোগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান। মাদক আর দুর্নীতি দুটোই আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ গরীব (!) দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিরাট বড় অন্তরায়। কারণ এই দুটোই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয়, শ্রেণি বৈষম্য বাড়ায়, মানুষের মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয়। এর ফলে আমাদের দেশের অন্যতম সম্পদ, মানব সম্পদকে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের দারিদ্রের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে। তাই আমাদের দেশের মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের উন্নয়নে মাদকের আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান খুব জরুরি, যেটা এখন সবে শুরু হয়েছে।

জানা গেছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লান্তি দূর করতে ও যুদ্ধের সময় লম্বা সময় সজাগ থাকতে হিটলারের নির্দেশে তার বৈজ্ঞানিকরা সেনাদের জন্য মেথঅ্যামফিটামিন সমৃদ্ধ ইয়াবা টাইপের ওষুধ আবিষ্কার করে। সে সময় এটাকে ‘নাজি স্পিড’ নামে ডাকা হতো। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত শিক্ষার্থী, দীর্ঘ যাত্রার গাড়িচালক ও দৌড়বিদেরা এটি ব্যবহার শুরু করেন। আইএস নামে পরিচিত ‘ইসলামী গ্রুপ’ তাঁদের শরীরে তাগতের জন্য ‘কেপ্টাগন’ নামের এক ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর ড্রাগ ব্যবহার করে, যা তাদের দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধের সময় শক্তি যোগায়, ক্লান্তি দূর করে। সেটাও অ্যামফিটামিন সমৃদ্ধ মাদক।‘কেপ্টাগন’ নামের এই ‘জেহাদি’ ড্রাগ এক/দুইবার ব্যবহার করলে আর এর থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। ‘কেপ্টাগন’ মনকে এক ট্রাকে নিয়ে আসতে পারে তাই আইএস এ আত্মঘাতী জেহাদির অভাব হয় না, এরা স্লিপার সেলের সদস্যদের মতো কাজ করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, ইয়াবা কিংবা ‘কেপ্টাগন’ যাই খান না কেন প্রাথমিকভাবে এটার প্রভাব খুব ভালো, আপনাকে শক্তি দেবে, ক্লান্তিকে তাড়িয়ে দিয়ে অনেক সময় ধরে যুদ্ধের মতো কঠিন কাজেও সজাগ রাখবে, কিন্তু পরে আপনি আসতে আসতে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবেন।

ধারণা করা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। মিয়ানমারের মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন যে, মিয়ানমারের বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ সেই দেশে প্রায় ৩৭টারও বেশি ফ্যাক্টরির মাধ্যমে ইয়াবা তৈরি করে পাশের সব দেশে পাচার করে তহবিল সংগ্রহ করে, তাদের কর্মকাণ্ড চালায়। সাম্প্রতিক অভিযানে, ধরা পড়া বাংলাদেশের এক মাদক ব্যবসায়ী রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার বিএনপি মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লাইলা সুলতানা লীজা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, এর থেকে করা আয়ের অংশ যায় বিলেতে, দলের খরচ চালাতে।
কোনো দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করতে বা কারও সম্পদ লুট করতে বা কব্জায় নিতে ড্রাগের ব্যবহার একটা পুরাতন কৌশল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাল থেকে এটা হয়ে আসছে, আমদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতেই কী তবে এই ইয়াবার ছোবল এসেছে আমাদের দেশে?

কেন মানুষ ইয়াবার মতো মাদক সেবন করে? প্রেমে বিফলতা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট কিনে (বেশিরভাগ, সব না) চাকরি না পাওয়ার ফলে হতাশা, অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে শুরু করা, অবৈধ পয়সার মালিক বাবা মায়েরা সন্তানদের সময় না দেওয়া থেকে আসা বিষণ্ণতা, টাকার পিছনে দৌড়ানো, পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতার অভাব, সুস্থ বিনোদনের অভাব, আকাশ সংস্কৃতির কু-প্রভাব ইত্যাদি নানা কারণে আমাদের দেশের যুব সমাজ এই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক বয়স্ক নিজেদের শরীরের তাগদ আনতে এক দুইবার সেবনের পরে বেশিরভাগই আসক্ত হয়ে পড়ে।
ইয়াবা সেবন মানুষকে কী করে? প্রথম প্রথম এটা খেলে মনটা খুব ফুরফুরে লাগে, শরীরে অনেক শক্তি পাওয়ার অনুভূতি পাওয়া যায়। পরে অভ্যাস হয়ে গেলে মাদক নেওয়ার ডোজ বেড়ে যায়। তখন মাদক না নিলে বা না খেলে আর ভালো লাগে না। দ্বিতীয় স্তরে তারা মাদকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন তারা পারিবারিক, সামাজিক রীতি নীতি আর মানে না। পরিবার থেকে টাকার যোগান আর পায় না। তাই নেশার টাকার যোগান নিতে যা ইচ্ছা তাই করে। নেশার একটা স্তরে তারা ভাবতে থাকে যে, তারা যা করছে সব ঠিক করছে। কারও কথা বা পরামর্শ নেয় না বা শোনে না। এভাবেই চলে যায় চতুর্থ স্তরে। তখন তাদের কাছে জীবনের আর কোন মানে থাকে না। তারা পুরোপুরি মাদকের কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। অসহায় মা-বাবা তাদের সন্তানের মৃত্যু নিজে চোখে দেখে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। পিতার কাঁধে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী সন্তানের লাশ।

ইয়াবা তৈরিতে খরচ কত, আর লাভ হয় কত? এটাকে ‘কিচেন কোম্পানি’ বলে থাকেন অনেকে। কারণ খুব ছোট্ট জায়গাতেই এই ইয়াবার উৎপাদন সম্ভব। সাধারণত চার কোয়ালিটির ইয়াবা আমাদের দেশে দেখা যায়। আমার অ্যামেরিকান এক কেমিস্ট বন্ধু বললেন, যদি ভেজাল না দেওয়া হয় (এখানে ভেজাল বেশি) তবে মান ভেদে ইয়াবা তৈরির কাঁচামালে খরচ হয় ২৫ টাকা থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত। যা বিক্রি হয় ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। এটাতে এতই লাভ হয় যে, রাতারাতি বড় লোক হতে কম বেশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেই এটাতে জড়াতে দেখা যায়। কম দামের নেশা খাইয়ে নেশা ধরাতে পারলে সেই ড্রাগ ডিলার হয়ে পড়ে নিজের নেশা মিটাতে। ড্রাগ ডিলারদের হাতে এত টাকা থাকে যে, উকিল, ব্যারিস্টার থেকে আরম্ভ করে সরকারি পদস্থ আমলা, রাজনীতিবিদসহ সমাজের সকল স্তরের লোকদের কেনার ক্ষমতা থাকে তাদের। কেনেও তারা, টাকায়, তাঁদের পক্ষে।
নীতি-হীনেরাই দুর্নীতি করে টাকা আয় করে তাই এদের মধ্যেই মাদক সম্রাট হবার আকাঙ্ক্ষা বেশি, হয়ও তাই। ধরা পড়ার পরেও আইনের ফাঁক দিয়ে নামী দামী উকিল, ব্যারিস্টারের সহায়তায় বেরিয়ে এসে আবার শুরু করে ব্যবসা। আমাদের দেশের যে অবস্থা তাতে আমাদের আগামী প্রজন্ম তথা দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এই মাদকের ছোবলে। মাদক বিরোধী অভিযান হলে মাদকের দাম বেড়ে যায়, লাভ বেশি। এমন অভিযোগ আছে যে, মাদক বিরোধী অভিযানে জড়িত অনেকে আবার উদ্ধার করা মাদকের সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়ে তা পরে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে বাড়তি টাকা আয় করে নেয়।

উন্নত দেশে ইয়াবার মত ড্রাগের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই। কলম্বিয়ায় তো ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর জাতিসংঘ মিলে কত কোটি টাকা এর জন্য খরচ করেছে তা নেট সার্চ দিলেই পাবেন। ৩০ বছর ধরে চলেছে এই যুদ্ধ, কিন্তু ফলাফল সুখকর না। কারণ সর্ষের ভিতরেই ভূত। ১৯৯০ সাল থেকে কলম্বিয়াতেই ৪৫০,০০০ মানুষকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে বা হত্যা করা হয়েছে। প্রতি ১ লাখ লোকের মধ্যে ২০ থেকে ৩৬ জনকে হত্যা করা হয় এই মাদক সম্পৃক্ততার জন্য, মাদক বিরোধী যুদ্ধে। তাও থামানো যায়নি। একই সময়ে পাশের দেশ মেক্সিকোতে ২,২০,০০০ মানুষকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়। জাতিসংঘ বলেছে ২০১৬ সালেই কলম্বিয়াতে কোকেনের উৎপাদন হয়েছে ৮৬৬ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে ছিলেন একটি ছোট্ট শহরের মেয়র। তিনি ক্রসফায়ারের মাধ্যমে এতই জনপ্রিয়তা পান যে, ভোটে দাঁড়িয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান। তিনিও ইদানীং দমে গেছেন, ক্রসফায়ার কমিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের দেশের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী নেই? আমাদের উচিৎ জাতিসংঘ, আমেরিকা ও ফিলিপাইনের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া। তবে আপাতত: মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার রাখা, ক্রসফায়ার অব্যাহত রাখা আরও কিছু দিন। কারণ এদের টাকার কাছে সমাজের অধিকাংশই অর্গান বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, যাবে। যদিও প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতাকারী ও মাদকের গডফাদারসহ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে শিগগিরই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক ও মাদকের গডফাদারসহ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হবে। তবে বাংলাদেশে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি দেওয়া খুব কঠিন। বেগম খালেদা জিয়া যে মামলায় জেল খাটছেন তা ৬০ কার্যদিবসে শেষ হবার আইন থাকলেও লেগেছে ১০ বছর। আবার অনেকে পুলিশ ভ্যানে থেকেও ফেসবুক লাইভে আসেন, জেলে থেকে বাবা হন, সে খবর সবাই জানেন।

একই সঙ্গে সারা দেশের সব হাসপাতালে মাদক নিরাময় কেন্দ্র খুলে নেশাগ্রস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কারণ চাহিদা না থাকলে ব্যবসা হবে না। তাই ইয়াবার চাহিদা কমাতে নেশাগ্রস্তদের সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ এটা একটা অসুখ। অপরদিকে অতিশয় দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষার সর্বস্তরে নৈতিকতা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। মাদকের ও দুর্নীতির কুফল শেখানো / পড়ানো। শিক্ষার কারিকুলামে তো বটেই এমন কী সিলেবাসে মাদক আর দুর্নীতির অপকারীটা নিয়ে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষাস্তরেও পাঠ চালু রাখা। বিশেষ করে শিক্ষার উচ্চস্তরে পেশাগত নৈতিকতার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। এর পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, যেমনটি হয়েছে ইসলামের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, আমাদের দেশে। তার একটা সুফল আমরা এখন পাচ্ছি। একমাত্র উচ্চ নৈতিকতার জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, অন্য কিছুতে নয়। অভিজ্ঞরা বলেন, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতার অব্যাহত চর্চা যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ গঠনের জন্য খুবই জরুরি।