স্মার্টফোন স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর

0
481
Cyber-bullying research...File photo dated 27/12/10 of the logo of social networking website Twitter seen displayed on the screen of an iPhone as children who are victims of cyber-bullying are more likely to use technology to pick on people themselves, according to research by Dr Shane Gallagher, from Cambridgeshire Educational Psychology Service. PRESS ASSOCIATION Photo. Issue date: Thursday January 13, 2011. The survey of secondary school pupils found girls were more likely to bully others using texts or the internet, as boys stuck to more traditional forms of cruelty. Child psychologist Gallagher also found that parents were unlikely to know the extent of the problem, whether their child was a victim or a bully. See PA story HEALTH Bullying. Photo credit should read: Dominic Lipinski/PA Wire

রিয়াজুল হক:
দিন দিন আমাদের চাহিদা যেন বেড়েই চলেছে। এই চাহিদা যে সবটুকুই প্রয়োজনীয়, সে কথা বলা উচিত হবে না। আভিজাত্যের তাগিদে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় অপ্রয়োজনেও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তবে আজকের শিক্ষিত বাবা-মায়েরা চাকরি, পার্টি, বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে অনেক ব্যস্ত। সন্তানের সকল আবদার-চাহিদা তারা টাকা দিয়ে পূরণ করতে চান। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যেন টাকার মাধ্যমে প্রকাশ করার রীতি চালু হয়েছে। ছোট খাটো শাসন যেন উঠেই যাচ্ছে।

স্মার্টফোন এখন সকলের হাতে হাতে। বড়দের বিভিন্ন কাজে স্মার্টফোনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্টফোন কতটা উপযোগী? স্মার্টফোনে আসক্তির বিষয়ে স্কুলের শিক্ষার্থী বলতে এখানে শুধু মাধ্যমিক নয়, প্রাথমিক পর্যায়েও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে।

কয়েকদিন আগে এক আত্মীয়ের সাথে আলাপ হচ্ছিল। ক্লাস ওয়ানে পড়া তার শিশুটি প্রথমে বাবার কাছ থেকে মোবাইলটি নিল। ইউটিউবে ঢুকে ইংরেজীতে ‘ড়মমু’ লিখে সার্চ দিল। তারপর একটা ভিডিও লিংকের উপর ছোট্ট আঙুল রেখে কার্টুন চালু করল। এরপর আধাঘন্টা শিশুটির আর কোন কথা নেই। নিজে নিজেই কার্টুন সিলেক্ট করে চালু করতে থাকল। বিপত্তি বাঁধলো যখন তার বাবা আমার সাথে ঘরের বাইরে আসার জন্য তার ছেলের কাছে মোবাইলটি চাইল। কিন্তু অবুঝ শিশুটি তো আর বাবার প্রয়োজন বোঝে না। সে মোবাইল কোন মতেই তার বাবাকে দিতে চাইল না। উপায় না দেখে মোবাইলটি ক্লাস ওয়ানে পড়া শিশুটির কাছে রেখেই ঘর থেকে বের হলেন। সাথে সেই আত্মীয় আমাকে আরো বলল, খাওয়ানোর সময় তাকে মোবাইল হাতে দিতে হবে, ঘুমানোর সময় তার হাতে মোবাইল দিতে হবে। এখন স্কুলে যাবার আগেও আমার মোবাইল সাথে নিয়ে যেতে চাইছে। বোঝো বিষয়টা কোন দিকে যাচ্ছে।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসের রিচার্ড মারফি ও লুইস-ফিলিপ বেলান্ড এক গবেষণার জন্য ৯১টি ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন। মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পর্কে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন নিয়মবলী আছে, যার সঙ্গে ১৬ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল তুলনা করে দেখা হয়। তাদের মতে, মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় শিক্ষার্থীদের উপর যে প্রভাব পড়েছে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন বাড়তি এক ঘণ্টা সময় দেওয়ার অথবা ক্লাসের দিন একদিন বাড়ানোর সমান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার নম্বর শতকরা ৬.৪ ভাগ বেড়েছে। এছাড়া, যেসব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ফলাফল খুব বেশি ভালো নয় তাদের ক্ষেত্রে নম্বর বেড়েছে ১৪ শতাংশ।

বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, মোবাইল ফোনে স্কুলের শিক্ষার্থীদের আসক্তির বিষয়ে। কম পয়সার অফার পেয়ে পছন্দের কারও সঙ্গে রাতভর কথা বলছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরীক্ষার ফলাফলে। কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখন আর কলরেটের উপর কথা বলা নির্ভর করে না। বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ যেমন ম্যাসেঞ্জার, ইমো, ওয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি চলে এসেছে। দুই ঘন্টা কথা বললে দশ টাকাও খরচ হয়না। সহজলভ্য এই অ্যাপ আমাদের স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা ক্ষতিকর, সেটা তাদের বুঝাবে কে? ক্লাসে বসেও আমাদের শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোনে চ্যাট করতে থাকে। আগে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগীতা করত, কে প্রথম সারির বেঞ্চে বসবে। এখন অনেকে প্রতিযোগীতা করে কে সব থেকে পিছনের সারির বেঞ্চে বসবে। কারণ শিক্ষকদের দৃষ্টির অগোচরে থাকা যায়। স্মার্টফোন নিয়ে সময় কাটানো যায়।

গবেষণা জানাচ্ছে, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট পিসি বা টেলিভিশনের আলো ঘুমের জন্য দায়ি হরমোনের বারোটা বাজিয়ে দেয়। আর অতিমাত্রায় এসব প্রযুক্তি নির্ভরতাই ডেকে নিয়ে আসছে অনিদ্রা।
রাতের বেলা মাত্র এক ঘণ্টা স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদির পর্দার আলোর সংস্পর্শে আসলে টিনএজারদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে মারাত্মকভাবে। এমনকি বিছানায় গড়াগড়ি দিয়েও পার করা লাগতে পারে গোটা রাত। আর বর্তমানে তো স্মার্টফোন বিছানাতেও অন্যতম সঙ্গী, এমনকি স্কুলের শিক্ষার্থীদের। বয়স্ক কৈশোরদের তুলনায় প্রাথমিক পর্যায়ের বয়ঃসন্ধিকালে বা ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সি ছেলে ও মেয়েদের ¯িøপ বায়োলাজি রাতের বেলা আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। রাতেই যদি শিক্ষার্থীদের ঘুম ঠিক মত না হয়, তবে পরের দিন স্কুলের জন্য সময় মতো ঘুম থেকে উঠতেও সমস্যা হয়। আর স্কুলে মনোযোগের বিষয়টি আরো পরের বিষয়।

অনেক অভিভাবকের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাইরে কর্মরত থাকেন বিধায় সারাক্ষণ সন্তানদের খোঁজ খবর রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়না। এরকম অবস্থায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চাদের মোবাইল দেয়ার কথা ভাবেন অভিভাবকেরা। তবে মোবাইল ফোন দেয়ার আগে তার বয়স উপযোগী মোবাইল ফোন পছন্দ করতে হবে। সন্তান যা চাইবে সেটা তার জন্য ক্ষতিকর কিনা, পিতা মাতাকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। আমাদের মায়েদের একটু বেশি সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। সন্তানের সব আবদার পূরণ করার মধ্যে সন্তানের মঙ্গল না থাকতেও পারে। কারণ মোবাইল আমাদের শিশু কিশোরদের জন্য মাদকদ্রব্যের মত হয়ে গেছে, যা পাবার জন্য তারা আবদার করে এবং পাবার পর লেখাপড়াসহ সবকিছু বাদ দিয়ে এই যন্ত্রটি নিয়েই পরে থাকে। ধীরে ধীরে তারা অন্যান্য অনেক বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নেশায় আসক্তরা যেমন নেশার বস্তু না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ে, এই শ্রেণীর রোগীরাও মোবাইল ব্যবহার করতে না পারলে বিষন্নতা ও শারীরিক অস্থিরতায় ভোগে। ই-মেইল আসার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও এক-দুই মিনিট পরপর জি-মেইল, ইয়াহু কিংবা হট-মেইল চেক করতে থাকে। এসব কিন্তু স্বাভাবিক কোন লক্ষণ নয়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ৮৯ শতাংশ স্নাতক শিক্ষার্থী যখন তাদের ফোন স্থির থাকে তখনও ‘অলৌকিক’ মোবাইল ভাইব্রেশনের অনুভূতি পান। দুশ্চিন্তা করার প্রাথমিক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এই ‘ফ্যান্টম ভাইব্রেশন’ নামের সমস্যাটিকে। প্রতি ১০ জন মোবাইল ব্যবহাকারীর সাতজনের মধ্যে এই সমস্যা থাকতে পারে। স্নাতক শিক্ষার্থীদের যদি এই অবস্থা হয়, তবে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অবস্থা অবশ্যই আরো বেগতিক হবে।

যন্ত্রনির্ভর বিশ্বে স্কুলের শিক্ষার্থীরা অনেক যান্ত্রিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। হাত বাড়ালেই স্মার্টফোন। অনেকেই ফেসবুক, চ্যাটিং, স্কাইপি, ইউটিউব আর মুভিতে তাদের অনেক মূল্যবান সময় ব্যয় করে থাকে। স্মার্টফোন থেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরানোর ফুসরৎ নেই। স্কুলের বন্ধুরা মিলে এখন আর দল বেঁধে বেড়াতে যেতে চায় না। এখন একসাথে ঠিকই বসে থাকে কিন্তু কারো সাথে কারো কথা হয় না। সবার চোখ নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। সময় চলে যায়, হৃদ্যতা বাড়ে না।

এই সমস্যা আরো প্রকট হবার পূর্বে সমাধান হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা যা চাইবে, সেটার সুবিধা অসুবিধা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। আজকের শিক্ষার্থীরা আগামীতে দেশের হাল ধরবে। তাদের লেখাপড়ায় ক্ষতি হয়, এমন সব কাজ থেকে তাদের বিরত রাখা উচিত। অনেক কিছুই তারা বোঝে না। এজন্য সকল বাবা-মা, স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবকসহ সকলকে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখকঃ উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক, খুলনা।