স্বর্ণ আমদানিতে আগ্রহ নেই, বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান

0
457

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই স্বর্ণসহ যাত্রীদের আটকের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব যাত্রী অর্থের বিনিময়ে শুধু স্বর্ণ বহনের কাজ করে থাকেন। এবার যাত্রীদের সাথে যুক্ত হয়েছেন এয়ারলাইন্সের কর্মীরাও। সম্প্রতি সাড়ে নয় কেজি স্বর্ণসহ এক কেবিন ক্রু আটক হন যিনি ইউএস বাংলায় কর্মরত ছিলেন। অবৈধভাবে সোনা চোরাচালানের কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। এছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দরে সর্বশেষ ২ কেজি ১৩৬ গ্রাম ওজনের কোটি টাকার স্বর্ণসহ সাত যাত্রীকে আটক করা হয়েছে। শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সূত্রমতে, ২০১০ সালের জুন থেকে এখন পর্যন্ত এ বিমানবন্দরে প্রায় ৬শ’ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় পরিবহকারীদের আটক করা গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এর পেছনের মূল হোতারা।
জানা গেছে, দেশে যে পরিমাণ সোনার প্রয়োজন হয় তার ৯০ শতাংশই পূরণ হয় অবৈধভাবে আসা স্বর্ণ দিয়ে। সূত্র জানায়, দেশে বছরে ২০-৪০ টন সোনা লাগে। দেশে সোনা ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২৮ হাজারের মতো। অবশ্য বৈধ ব্যবসায়ী মাত্র ৩২ হাজার। ঢাকা শহরে স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে লাইসেন্স আছে মাত্র ৮০৩ প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১১ মার্চ সোনা আমদানির ডিলার নিয়োগের জন্য আবেদন আহŸান করে, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ৪ ব্যবসায়ী সোনা আমদানি করতে আবেদন করেছেন। ডিলার লাইসেন্সের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম মেনে যেসব প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা হবে, তারাই লাইসেন্স পেতে পারে। সোনা আমদানিতে প্রতিপদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। তাই যেকোন সময় লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ আছে। কিন্তু ৪ মাসে মাত্র ৪ ব্যবসায়ী আবেদন করেছেন। এতেই বোঝা যায় সোনা আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই। তারা চোরাইপথে আসা সোনা কিনতেই অধিক আগ্রহী।
এদিকে, প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ সোনা আসছে। এর মধ্যে সামান্য কিছু সোনাই দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থার হাতে ধরা পড়ে। চোরাইপথে আসার পর বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে ধরা পড়ে সোনার বার ও স্বর্ণালঙ্কার। নিয়মানুযায়ী তা জমা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে বর্তমানে জমা রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৭৭ কেজি সোনা। এর মধ্যে মামলা প্রক্রিয়ায় আলামত হিসেবে স্বর্ণবার ও স্বর্ণালঙ্কার মিলিয়ে জব্দ রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৩০ কেজি। চোরাই হিসেবে আটক সোনা নিলামে বিক্রির বিধান থাকলেও মামলার আলামত হিসেবে আইনি বেড়াজালে আটকা থাকে বিপুল স্বর্ণ। ১১ বছর পর নিলামের মাধ্যমে সোনা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, যেসব স্বর্ণের বিপরীতে করা মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং ভল্টে রাখা স্বর্ণ যদি আদালতের মাধ্যমে সরকারের অনুক‚লে জব্দ করা হয়, সেসব স্বর্ণ নিলাম করা হয়। তবে যেসব স্বর্ণের বার ‘বিস্কুট’ আকারে আছে, সেগুলোকে বিশুদ্ধ স্বর্ণ মনে করা হয়। এগুলো সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নেয়। পরে তারা এগুলো রিজার্ভে দেখানোর জন্য ভল্টে রেখে দেয়। নিলামের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে বিভিন্ন সময় চোরাইপথে আসা জব্দকৃত স্বর্ণের বার জমা রয়েছে ২ হাজার ১৩১ কেজি ৫৫৪ গ্রাম ৫৪০ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে আটক স্বর্ণালঙ্কারের মজুদের পরিমাণ ৮৪৫ কেজি ৮২৬ গ্রাম ৬৬৩ মিলিগ্রাম। এসব স্বর্ণের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়াধীন সোনার বারের পরিমাণ ২ হাজার ১১১ কেজি ৮০ গ্রাম ৮৪০ মিলিগ্রাম এবং স্বর্ণালঙ্কার ৮১৯ কেজি ২৮১ গ্রাম ১৯৩ মিলিগ্রাম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সোনা পাচারের অর্ধশতাধিক মামলা প্রায় ধামাচাপা পড়ে আছে। অধিকাংশ মামলারই অগ্রগতি শূন্যের কোটায়। কোন কোন মামলা ঝুলে আছে বছরের পর বছর। তদন্তের নামে বিভিন্ন সংস্থার হাতবদল হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়ায় যেতেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। উল্টো বরাবরের মতো আড়ালেই থাকছে চোরাচালানী সিন্ডিকেটের সদস্যরা। অন্যদিকে জড়িতরা শাস্তির মুখোমুখি না হওয়ায় স্বর্ণ চোরাচালানের প্রবণতাও বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, চোরাইপথে আসা স্বর্ণ সংক্রান্ত বেশিরভাগ মামলা বিচারাধীন। আর বিচারাধীন থাকায় ওসব স্বর্ণালঙ্কার নিলাম হচ্ছে না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোনার বার বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামে দেয় না। প্রয়োজন মনে করলে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নিয়ে রিজার্ভে যুক্ত করে।
এদিকে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং ঢাকা কাস্টম হাউস সংস্থা দুটির কর্মকর্তারা জানান, অনেক সময় বিমানবন্দর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় বহু স্বর্ণ জব্দ করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসব স্বর্ণ এ দেশে আনলেও মূলত তা সীমান্ত পেরিয়ে চলে যাচ্ছে পাশের দেশগুলোতে। তবে গোয়েন্দা ও কাস্টমস সূত্র বলছে, এখন অবৈধ পথে দেশে স্বর্ণ আসা অনেকটাই কমে গেছে। মাঝেমধ্যে চোরাইপথে কিছু স্বর্ণ এলেও সেগুলো গোয়েন্দাজালে ধরা পড়ছে। কিছু আবার গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সীমান্ত পথে স্বর্ণ চোরাচালানি থেমে নেই। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বর্ণের ব্যাপক চাহিদা ও শুল্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা কার্যকর না হওয়ায় উদ্বেগজনক হারে স্বর্ণ চোরাচালান চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এসব পথে অবাধে চলছে স্বর্ণ চোরাচালানের মতো ঘটনা। আশঙ্কার কথা হলো, সীমান্তে অস্ত্র ও মাদকের বিনিময় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এসব স্বর্ণ। জানা গেছে, থানায় কারও বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করা হলে পুলিশ তদন্তে নামে। তদন্তে কারও দোষ পাওয়া গেলে সেই ব্যক্তির বিচারের জন্য আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনটি হচ্ছে অভিযোগপত্র। আর তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়া গেলে, প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলে কিংবা অপরাধের সঙ্গে আসামিদের সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে পুলিশ আদালতে চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদনের পর মামলা খারিজ হয়ে যায়। আর স্বর্ণ আটকের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা এবং আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলেও রহস্যজনক কারণে মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কিছু রাজনীতিবিদ স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এ কারণে মূল হোতারা চিহ্নিত হলেও তারা আড়ালেই থাকছে।