সমাজের দৈন্যতা, দৈন্যতার সমাজ ও আমরা

0
831

কৌশিক দে:
কথায় আছে যে দিন যায়, সেটিই ভাল যায়। বাস্তবেও এর ভিন্নতা খুব কম। আমরা শিশু, কিশোর ও যুবক বয়স পার করেছি; এখন পরিপূর্ণ বয়স উপভোগ করছি। প্রতিদিনের দিনলিপিগুলো বিশ্লেষণ করলে ফেলে যাওয়া দিনগুলো নিয়ে শুধু কষ্ট বাড়ে। দশ বছর আগের আমি আর এখনকার আমিতে যে বড় ধরণের পার্থক্য দেখা দিচ্ছে, তা মাঝে মধ্যে মনে হয়। তেমনিভাবে পাল্টে গেছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, শ্রদ্ধাবোধ। পাল্টে গেছে সহনশীল মনমানসিকতা। আগে পারত পক্ষে কেউ গায়ের চামড়া খুলে নিলেও মেজাজটা ধরে রাখার সামর্থ্য ছিল। এখন সে অবস্থা নেই। সামান্য ঘটনায় নিজেকে ধরে রাখা কষ্টসাধ্য। শুধু আমার নয়, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন ধৈর্যহীনতার ঘটনা ঘটে চলছে। আর সেইসব ঘটনা এমন ভয়ংকর তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না।
সাম্প্রতিক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি রোমহর্ষক ঘটনা বিবেকবান মানুষ মাত্রেই আলোড়িত করেছে। বিশেষ করে লোভ-কামা ও ক্ষোভের আগুনে একের পর এক শিশু-কিশোর কোনভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। মায়ের কাছে বা পরিবারের প্রিয় ব্যক্তির সাথে শিশু-কিশোররা নিরাপদ না হলে তারা কোথায় যাবে। দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবয় থেকেই ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে নৈতিক অবয়ের ত্রে। তথ্য-প্রযুক্তি, আকাশ সংস্কৃতি ও অতি-আধুনিকতায় আসক্তি বা এসবের অপ্রয়োগ এই অবয়কে ত্বরান্বিত করছে। এ ছাড়া অর্থের লোভ, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদাসীনতা, ধর্মীয় সংস্কারকে অবজ্ঞা করার মতো মানসিকতাও অনেক পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে; পরিবারে ঘটছে হৃদয়বিদারক অপরাধমূলক ঘটনা। এর সঙ্গে ওথেলো সিনড্রোমের মতো মনোদৈহিক সমস্যাও জড়িত।’
গেল সপ্তাহ আগে রাজধানীতে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে; নিহত চারজনের মধ্যে দুজনই ছিল অল্পবয়সী। একটি ঘটনায় মাকে হত্যা করতে এসে তাঁর ছেলেকেও খুন করা হয়, অন্যটিতে এক মেয়ে তার বাবার হত্যাকান্ড দেখে ফেলার মূল্য দেয় জীবন দিয়ে। এছাড়া মানিকগঞ্জে ১৪ বছরের বৃষ্টি আক্তারকে জবাই করা হয়েছে বিয়েতে রাজি না হওয়ায়। টাকা চুরির অপবাদে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে এক শিশুর হাতের আঙুলে পিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। হত্যাকান্ডে শিকার হয়েছে নারায়ণগঞ্জে জেএসসি পরীার্থী প্রিয়ঙ্কা। আমাদের খুলনায় শিশু রাকিব হাওলাদারকে তুচ্ছ ঘটনায় মোটরসাইকেল গ্যারেজ মালিক ও তার সহযোগী মলদ্বারে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। ঘাতক দুজনই এখন কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত।
আমাদের বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। যুগ যুগ ধরে এই কৃষিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে আমাদের সৌহার্ন্দ্য ও সম্প্রতির বন্ধন। কৃষিকাজ মানুষকে সম্মিলিত কাজ করার মানসিকতা তৈরী করেছিল। দরিদ্র জনগোষ্ঠী একে অপরের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন বড় বড় ফসলী খামার। কারো হয়তো গরু ছিল, কারো বীজ ধান আবার কারো শ্রম। কিন্তু দিন দিন আমাদের আর্থিক সামর্থ্য ও সক্ষমতা ওই সম্প্রতিকে নষ্ট করে দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও আর্থিক সামর্থ্য আমাদের একক চিন্তার উম্মেষ ঘটিয়েছে। এখন কারো টাকা থাকলেই সে তার বিশাল জমিতে ফসল ফলাতে পারেন। আবার কারো টাকা থাকলে মৎস্য খামার, গরুর খামার এমন কী হাতির খামারও চালাতে পারেন। তাই আমরা এক প্রকার যান্ত্রিক মানুষ হয়ে গেছি। আর্থিক সামার্থ্য বাড়াতে সেখানেই মেধা ও শ্রম ব্যবহার করতে শারীরিক সামার্থ্য হারিয়ে ফেলছি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা ও সৌহার্ন্দ্য নষ্ট করছি। দিন সমাজ, পরিবার বিচ্যুত হচ্ছি। যার প্রভাব পড়ছে সমাজে।
আকাশ সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধনহীনতা, ঈর্ষা আমাদের বিপদগামীতার পথে ঠেলে দিচ্ছে। কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘রাষ্ট্র ও সমাজের দিক থেকে অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে অনেক ধরনের পদপে রয়েছে। স্বামী বা স্ত্রীর অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ককে পরকীয়া বলে অভিহিত করার মাধ্যমে সমাজ এই সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান বা নিন্দা জানিয়েছে। তার পরও যুগ যুগ ধরে এমন সম্পর্ক ঘটেই চলেছে। রাষ্ট্র আইনি কাঠামোতেও এমন সম্পর্ক সমর্থন করে না বরং অবৈধ হিসেবে ধার্য করেছে। সুতরাং পরিবার ও ব্যক্তির মূল্যবোধকেই এসব থেকে রায় সবার আগে জাগ্রত করতে হবে। তাঁর মতে, এ েেত্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে ব্যক্তি নিজে এবং পরিবার; তার পরের ভূমিকাটি সমাজের। তিনি আরো বলেন, ব্যক্তি ও পরিবারের সম্পর্কে ফাটল ধরলেই মনুষ্যত্ববোধের ঘাটতি তৈরি হয় এবং সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এর প্রভাব মাত্র।’ আরেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগীন বলেন, ‘আমাদের দেশে নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংসের পেছনে এখন ফেসবুকসহ অনলাইনের অপ্রয়োগের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এখনো এ প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি অনেকেই। অনেক েেত্র কেউ কেউ নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। অনেকের পইে বন্ধুত্বের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যা রীতিমতো আসক্তিতে পরিণত হয়। এগুলোও এখন ঘরে ঘরে অশান্তির বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।’
বিশেষজ্ঞদের এসব অভিমতে আমাদের সমাজ ও পরিবারের বর্তমান অবস্থা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মূলত: আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের মর্যাদা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। লোভ, ক্ষোভ, কাম ও ক্রোধ আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- এ যাত্রার শেষ কোথায় বলা মুশকিল।
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ, খুলনা ব্যুরো।