শেখ মুজিবঃ চির-উন্নত শির

0
550

এ্যাড. মোঃ সাইফুল ইসলাম :

হুমায়ন আজাদের মতে, ‘শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উচুঁতে ছিল তার মাথাটি, সহজেই চোখে পড়তো তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সকল বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম’।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন এবং ২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার পর ২৬ মার্চের রক্তলাল সূর্যোদয় বয়ে এনেছিল বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। এদিনই সূচিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষের ভোটে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। সাধারণ জনগনের রায় মেনে নিতেও স্বৈরশাষক দলের আপত্তি ছিল। মূলত একাত্তরের মার্চের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিরোধী সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকাসহ সারা দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, কলকারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে সারাদেশ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার বিশাল জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন,‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে দেশটি আজ প্রতিষ্ঠিত তার অবয়ব তৈরির কাজটি করেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণার পরপরই স্বাধীনতার জন্য বাঙালী জাতি চূড়ান্ত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সারাদেশে বেজে ওঠে স্বাধীনতার দামামা। শুরু হয় জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার যুদ্ধ।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে, আগামী ২৭ মার্চ সমগ্র দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতাল পালন করা হবে। শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে যখন এই হরতালের ঘোষণা করা হচ্ছিল ঠিক তখনই সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিমান প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে। রাত ১১ টা ৩০ মিনিটে ট্যাঙ্ক এবং সৈন্যভর্তি ট্রাকগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুর উদ্দেশ্যে। অপারেশন সার্চলাইট মনিটর করার জন্য ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের হেড কোয়াটার্স লনে জেনারেল আব্দুল হামিদসহ সব উচ্চপদস্থ অফিসার সোফা এবং আরামকেদারা ফেলে তৈরি হন সারারাত জেগে কাটানোর জন্য। ‘আকাশে তারার মেলা। শহর গভীর ঘুমে নিমগ্ন। ঢাকার বসন্তের রাত যেমন চমৎকার হয়, তেমনি ছিল রাতটি। একমাত্র হত্যাকান্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞ সাধন ছাড়া অন্য সবকিছুর জন্যই পরিবেশটি ছিল চমৎকার’( নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃষ্ঠা ৮৪)। আঘাত হানার সময় ছিল জিরো আওয়ার বা রাত ১ টা। কিন্তু হানাদার বাহিনী ফার্মগেটের সামনে এলেই পিকেটারদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয় এবং পিকেটারদের হটানোর জন্য জিরো আওয়ারের পূর্বেই শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট। অপারেশন শুরুর দেড় ঘন্টার মধ্যেই কর্নেল জেড এ খান ও মেজর বিল্লাল রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাঙ্ক, সাজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য নিয়ে স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসার দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। তখন বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালীর মতোই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসে। গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু গোপন ওয়ারলেসে ইংরেজীতে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যার বাংলা অনুবাদ হলো, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি দ্রুত তৎকালীন ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়। একই সঙ্গে তিনি বাংলায় যে বার্তাটি পাঠান,‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন এবং আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রেক্ষিতে লাখ লাখ বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার প্রচেষ্টা চালায়। গোটা দেশ রণাঙ্গনে পরিণত হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ প্রাণ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি প্রতিক্ষিত সেই স্বাধীনতা।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্খা এই দেশের মানুষের মধ্যে জাগ্রত করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ, দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। অথচ সামান্য কিছু বিপথগামী মানুষ সত্যকে সত্য বলতে কুন্ঠিত হয়। ইতিহাস বিকৃত করার ক্ষেত্রে তাদের মত সিদ্ধহস্ত খুব কম সংখ্যক প্রাণী আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যেই একজন শেখ মুজিবের জন্যে বাংলাদেশ অধিকাংশ বাঙ্গালীর মানে সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের বৈধ কর্তৃত্ব ও তার কার্যকর রূপকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা বা স্বীকৃতি দান। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অহেতুক এক বিতর্ক সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। এটা জাতির লজ্জা। ভাবখানা এমন যে, মন চাইলেই যে কেউ স্বাধীনতার ডাক দিতে পারে আর এমন এক আজগুবি ও উদ্ভট মিথ্যা দীর্ঘকাল ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে এখানে। এ কথা তো মানতে হবে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো কর্তৃত্বের বা বৈধ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আসতে হবে। তা না হলে বিশ্বের যে কোন নাগরিকই যে কোনো প্রকার বৈধ কর্তৃত্ব ছাড়াই সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই জনগণ তা গ্রাহ্য করবে কেন; আর ১৯৭১ এর বাংলায় এতো ছিল কল্পনার অতীত। বাস্তবের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে একজন অজানা-অচেনা লোকের ঘোষণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই আশঙ্কাই সৃষ্টি করত যে বাংলাদেশ নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হতে চলেছে। এ সময় স্বাধীনতার ডাক দেয়ার সর্ব প্রকার বৈধ ও নৈতিক অধিকার ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর। কেননা তাঁর ছিল নির্বাচনী বৈধতা এবং বাংলাদেশের জনগণের হয়ে কথা বলার নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ম্যান্ডেট আর তাই জনগণের কাছে একমাত্র তাঁর কথাই ছিল গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য অন্য কারও নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত ও একক নেতারূপে বিশ্বে তাঁর পরিচিতি ততদিনে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধ ঘোষক যে একমাত্র তিনিই হতে পারেন বিশ্ববাসীর এ সত্যটি বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। অদম্য সাহসী মহান এই ব্যক্তিত্ত্বের জন্যেই আজ আমরা স্বাধীন। আজ আমাদের সকলের দায়িত্ব মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশর প্রকৃত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, অর্জন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তবেই সার্থক হবে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের সব আনুষ্ঠানিকতা।

লেখকঃ সভাপতি, সদর থানা আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর, খুলনা।