শুরু হতে যাচ্ছে ইপিএল’র নতুন মৌসুম

0
299

টাইমস ডেস্ক স্পোর্টস: প্রতিটি ম্যাচ যেন একটি যুদ্ধ। প্রতিটি পয়েন্ট পেতে হয় লড়াই করে। চ‚ড়ায় থাকা দলকে চমকে দেয় তলানির কোনো ক্লাব। ২০ দলের লড়াইয়ে বছর জুড়ে চলে তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতা। মহামারীকালেও ধার কমেনি একটুও। মাস তিনেকের বিরতির পর শুরু হতে যাচ্ছে নতুন মৌসুম। মাঠে গড়াতে চলেছে ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। ২০২০-২১ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ নানা কারণেই ছিল আলোচিত-সমালোচিত। করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে বারবার। আক্রান্ত হয়েছেন খেলোয়াড়সহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই। মহামারীর মধ্যে আঁটসাঁট সূচিতে গতিময় ফুটবল খেলতে গিয়ে চোটে পড়েছিলেন অনেক খেলোয়াড়। কোচদের জন্য কোনো স্কোয়াডই যেন যথেষ্ট ছিল না। কখনও কখনও একাদশ সাজাতে যুব দল থেকে খেলোয়াড় আনতে হয়েছে। ফিফা সর্বোচ্চ পাঁচ জন বদলি নামানোর সুযোগ রেখেছিল, কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো তিন বদলিতেই থেকে যায়। এর জন্য খেলোয়াড়দের দিতে হয় চড়া মাশুল। নিয়মিত অনেক মুখ লম্বা সময় ছিলেন মাঠের বাইরে। তবে মাঠের ফুটবল ছিল বরাবরের মতোই গতিময়। আরেক বিপত্তি ছিল ভিএআর। বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে প্রায়ই। বিশেষ করে হ্যান্ডবল নিয়ে। খোদ কোচরা পর্যন্ত ধন্দে ছিলেন; কোনটা হ্যান্ডবল, কোনটা নয় তা নিয়ে। ভিএআরের জন্য মাঝে মধ্যেই খেলায় পড়েছে লম্বা বিরতি। এতে ছন্দপতন হয়েছে বেশ, তারওপর এসেছে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। সব মিলিয়ে ভিএআর এর দ্বিতীয় মৌসুমে নেতিবাচক ছাপই ফেলেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ভিএআর চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই এসেছে অভিমত। কিছুকিছু ব্যাপার আরেকটু পরিষ্কার করে বিতর্ক যত সম্ভব কমিয়ে আনার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। দলগুলো অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের। যে যার মতো লক্ষ্যও স্থির করে নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। গত আসরের শুরুটা কেমন ছিল পেপ গুয়ার্দিওলার দলের? “আমি বার্সেলোনায় হেরেছি, আমি মিউনিখে (বায়ার্ন) হেরেছি, কিন্তু আমি সবসময় আমার দলকে চিনতে পেরেছি। তবে সেই সময়টাতে (মৌসুমের শুরুর দিকে) আমি নিজের দলকেই চিনতে পারিনি, ওটা আমার পছন্দ হয়নি।” লিগ জয়ের পর মৌসুমের শুরুতে নিজ দলের খেলা নিয়ে এভাবেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন গুয়ার্দিওলা। অথচ তার দলই কিনা শিরোপা নিশ্চিত করে কয়েক ম্যাচ হাতে রেখে! ২০১৯-২০ মৌসুমে লিভারপুলের কাছে লিগ শিরোপা খোয়ানোর পর গত আসরের শুরুটা একেবারেই আশানুরূপ ছিল না সিটির। ফরমেশন নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন গুয়ার্দিওলা, যা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনেনি। একের পর মূল্যবান পয়েন্ট খুইয়ে ক্রমেই পয়েন্ট টেবিলে পিছিয়ে যেতে থাকে তারা। চোটের কারণে অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ড সের্হিও আগুয়েরো ছিলেন অনিয়মিত। আরেক ফরোয়ার্ড গাব্রিয়েল জেসুসও চোটের কারণে মিস করেন বেশ কিছু ম্যাচ। বড় দিনের বিরতির আগে ১৩ ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে সিটি ছিল আটে, যার মধ্যে ছিল লেস্টার সিটির বিপক্ষে ৫-২ গোলের হার। সিটির নিজেদের হারিয়ে খোঁজার সময়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষস্থান নিয়ে চলছিল তুমুল প্রতিদ্বন্দিতা। যেখানে দুর্দান্ত শুরুতে প্রথম কয়েক রাউন্ডে শীর্ষে ছিল এভারটন। তবে দ্রæতই তাদের হটিয়ে ডিসেম্বরে টেবিলের শীর্ষে চলে আসে লিভারপুল। পিছিয়ে ছিল না লেস্টার সিটি, ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড, চেলসিও। ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত ছিল টটেনহ্যাম হটস্পারের খেলাতেও। ইউনাইটেডকে তাদেরই মাঠে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত করে জোসে মরিনিয়োর দল আশাবাদী করছিল দলটির সমর্থকদের। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগে ১৪ ম্যাচ থেকে ৩১ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে ছিল লিভারপুল। পরের তিনটি অবস্থানে ছিল যথাক্রমে (লেস্টার সিটি ২৭ পয়েন্ট), ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড (২৬ পয়েন্ট), এভারটন (২৬ পয়েন্ট)। ২৫ পয়েন্ট নিয়ে পাঁচ ও ছয়ে ছিল চেলসি ও টটেনহ্যাম। তবে শুরুর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি কোনো দলই। যার শুরুটা হয় লিভারপুলকে দিয়েই। চোটের কারণে ডিফেন্সের দুই মূল স্তম্ভ ভার্জিল ফন ডাইক ও জো গোমেজ ছিটকে যান পুরো মৌসুমের জন্য। বিশেষ করে ২০১৯ সালের উয়েফা বর্ষসেরা ফুটবলার ফন ডাইকের চোট ইয়ুর্গেন ক্লপের দলের জন্য ছিল বড় ধাক্কা। অ্যানফিল্ডে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ছয় ম্যাচ হারা লিভারপুলকে সংগ্রাম করে নিশ্চিত করতে হয়েছে সেরা চারে থাকাটা। দারুণ শুরুর পর পথ হারায় চেলসিও। একপর্যায়ে পয়েন্ট টেবিলের নয় নম্বরে চলে যায় স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের দলটি। মৌসুমের মাঝপথে প্রবল চাপে থাকা কোচ ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে সরিয়ে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় টমাস টুখেলের হাতে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তারা। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ক্লাবের চিত্র বদলে দেন টুখেল। আক্রমণে ধার বাড়ানোর পাশাপাশি গড়ে তোলেন জমাট রক্ষণ। তাতে প্রিমিয়ার লিগে চারে থেকে শেষ করার পাশাপাশি চেলসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জয় করে লিগ চ্যাম্পিয়ন সিটিকে ফাইনালে হারিয়ে। বাকি দলগুলোর ব্যর্থতার সুযোগে বছরের শুরু থেকে নিজেদের গুছিয়ে নিতে থাকে সিটি। তারই ধারাবাহিকতায় ফেব্রæয়ারি ও মার্চে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত ছিল তারা, যা টেবিলের শীর্ষে তাদের অবস্থান করে সুসংহত। এরই ধারাবাহিকতায় দুই রাউন্ড বাকি থাকতেই শেষ পাঁচ মৌসুমে চতুর্থ লিগ শিরোপা জিতে নেয় ইতিহাদের দলটি। এতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তারকা মিডফিল্ডার কেভিন ডে ব্রæইনে ও পর্তুগাল ডিফেন্ডার রুবেন দিয়াস, যিনি প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। সিটির নগর প্রতিদ্ব›দ্বী ম্যানচেস্টারের ইউনাইটেড মৌসুমের দ্বিতীয় অংশের অনেকটা সময় জুড়েই দুইয়ে থাকলেও শিরোপার লড়াইয়ে তারা ছিল না কখনই। তবে সেরা চারে থাকার তীব্র প্রতিদ্বন্দিতায় দলকে দুইয়ে রাখার জন্য বাহবা পেতেই পারেন কোচ উলে গুনার সুলশার। সময়ের সাথে দলকে গুছিয়ে আনেন তিনি। অ্যাওয়ে ম্যাচে রীতিমত দুর্ভেদ্য ছিল ইউনাইটেড। পুরো লিগ জুড়েই প্রতিপক্ষের মাঠে অপরাজিত ছিল তারা। এর আগে ইংলিশ ফুটবলের টপ টায়ারে মৌসুমজুড়ে অ্যাওয়ে ম্যাচে অপরাজিত থাকার কীর্তি ছিল প্রেস্টন নর্থ এÐ (১৮৮৮-৮৯) ও আর্সেনালের (২০০১-০২ ও ২০০৩-০৪)। আর্সেন ভেঙ্গারের সময়ের সেই সুদিন অনেক আগেই ফেলে আসা আর্সেনাল এবার ছিটকে যায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ তো বটেই, এমনকি ইউরোপা লিগের সমীকরণ থেকেও। শেষ পাঁচ ম্যাচ টানা জিতেও আটে থেকে মৌসুম শেষ করে মিকেল আর্তেতার দল। তাতে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি দলটি। ভুলে যাওয়ার মত সময় গেছে লন্ডনের আরেক ক্লাব টটেনহ্যামেরও। অথচ দলের দুই তারকা ফরোয়ার্ড হ্যারি কেইন ও সন হিউং মিনের নৈপুণ্যে শুরুতে ভিন্ন কিছুর স্বপ্ন দেখছিল মরিনিয়োর দল। কিন্তু লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা কেইনের (২৩ গোল) চোট, দুর্বল ডিফেন্স ও অধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয় টটেনহ্যাম। মৌসুম শেষের আগেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মরিনিয়োকে। দুই বড় ক্লাবকে হটিয়ে শীর্ষ ছয়ে থেকে চমক দেখিয়েছে লেস্টার সিটি ও ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড। যদিও লেস্টারের সামনে শেষ পর্যন্ত সুযোগ ছিল চারে থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার। লিভারপুলের শেষ পাঁচ ম্যাচে টানা জয় এবং নিজেদের ব্যর্থতায় সুযোগ হাতছাড়া হয় তাদের। সীমিত বাজেটের দল নিয়ে বাজিমাত করেন সাবেক ইউনাইটেড কোচ ডেভিড ময়েস। মৌসুম শুরুর আগে ওয়েস্ট হ্যামকে ছয়ে দেখার আশাবাদী মানুষের সংখ্যাটা ছিল নেহায়েত কমই। তবে ২০২০-২১ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবলের জন্য পুরস্কার বরাদ্দ থাকলে সেটা নিশ্চিতভাবে জিতে নিত ১৬ বছর পর শীর্ষ লিগে ফেরা লিডস ইউনাইটেড। আক্রমণ, আক্রমণ এবং আক্রমণ – এই মন্ত্রে খেলা মার্সেলো বিয়েলসার দল মৌসুম জুড়েই উপহার দিয়েছে উপভোগ্য ফুটবল। এর খেসারতও দিতে হয়েছে তাদের। লম্বা সময় ধরে একই স্টাইলে খেলায় প্রতিপক্ষ তাদের খেলার ধরন ধরে ফেলতে শুরু করে। যার প্রভাব পড়েছে লিগে লিডসের সামগ্রিক ফলাফলে। তবে প্রত্যাবর্তন মৌসুমে ৯ নম্বরে থেকে শেষ করাটাও বড় প্রাপ্তি বিয়েলসার দলের জন্য। অনবম হয় পয়েন্ট টেবিলের শেষ তিনে থাকা ফুলহ্যাম, ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড ও শেফিল্ড ইউনাইটেড। লিগের শেষ দিকে কিছু দর্শক ফিরেছিল মাঠে। এবার থাকবে শুরু থেকেই এবং ধারণক্ষমতার শতভাগ নিয়ে। তাতে হয়তো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে ২০২১-২২ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ।