শিক্ষাধারা : দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলুন যাই যুদ্ধে

0
302

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া অন্ধকারের মানুষগুলোকে চিহ্নিত করার সময় এখন। সময় এখন নীতির উপর ভর করে দুর্নীতিকে না বলার। আর সেই সময়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তাদের হাত ধরেই দেশে পরিবর্তন আসবে। শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার সরকার পাশে আছে। তিনি বলেন, আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে অগ্রগামী, চিন্তা-চেতনায় প্রগতিশীল। সততা, মানবিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, শরীর-মনে সুস্থ ও কর্মে উদ্যমী একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই। আমাদের বইয়ের চাপে পিষ্ট শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী বলে যাচ্ছেন- তোমরা বাল্যবিবাহ, যৌতুক, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। বাল্যবিবাহ, নারীর ক্ষমতায়ন ও জাতীয় উন্নয়নে অন্যতম অন্তরায়। তোমরা নিজেদের সব ধরনের সংকীর্ণতা থেকে দূরে রাখবে। নিজেরা পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হবে এবং অন্যদেরও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করবে। মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা থেকে নিজেদের দূরে রাখবে। বাংলাদেশকে তোমরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরাই গড়ে তুলবে আগামীর সুখী-সমৃদ্ধ দেশ।

কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী কি একবারও সেই শিক্ষা কর্মকান্ডের নামে যারা দুর্নীতি করছেন, তাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করছেন? উত্তর হবে না, আর এই ‘না’-এর কারণে ‘নতুন প্রকল্পের ফাঁদে উপবৃত্তি বন্ধ দেড় কোটি শিক্ষার্থীর’ শিরোনাম হচ্ছে। বাড়ছে অর্থ আত্মসাতের মহা উৎসব।  যে কারণে নতুন বছরের প্রথম দিনে হাতে নতুন বই পেলেও খুশি মনে স্কুলে যেতে পারছে না সারাদেশে দেড় কোটি খুদে শিক্ষার্থী। অন্যান্য বছরের মতো এবার নতুন বইয়ের সঙ্গে উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে না। ‘প্রকল্প শেষে নতুন প্রকল্প হবে’- এমন ফাঁদে আটকে গেছে প্রাথমিকের উপবৃত্তি। তবে নতুন প্রকল্প কবে পাস হবে, কবে নাগাদ উপবৃত্তি শুরু হবে তা কেউ বলতে পারছে না। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায়) মেয়াদ গত ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির টাকা দেয়া হতো। কিন্তু গত তিন মাস ধরে প্রাথমিকের এসব শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা বন্ধ রয়েছে। হতদরিদ্র শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ায় নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলেও শিক্ষাসামগ্রী কিনতে পারছে না। দ্রম্নত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা বিতরণের ব্যবস্থা না করলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে এরই মধ্যে মাধ্যমিক স্তর বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সাড়ে ২৩ লাখ শিক্ষার্থী। গত ৩১ ডিসেম্বর উপবৃত্তি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এসব শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা আদৌ পাবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

যতদূর জেনেছি- উপবৃত্তি সুবিধাভোগীর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৮ লাখ ৭০ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ ২০১৫ সালের ৩০ জুন শেষ হয়। এরপরে আরও দুই বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তৃতীয় পর্যায় প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়, পরে এর সঙ্গে আরও ১০ লাখ শিক্ষার্থী যুক্ত হয়। প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলে আরও দুই বছর সময় বাড়ানো হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৮৫৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে নতুন করে ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৯২৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। একজন শিক্ষার্থী বিশিষ্ট পরিবারকে মাসে ১০০ টাকা, দুই শিক্ষার্থী বিশিষ্ট পরিবারকে ২০০ টাকা, তিন শিক্ষার্থী বিশিষ্ট পরিবারকে ২৫০ টাকা ও চার শিক্ষার্থী বিশিষ্ট পরিবারকে মাসে ৩০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রতি তিন মাস পর পর উপবৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মোবাইলে রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত তিন মাসে কোনো শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হয়নি। শুধু এখানেই শেষ নয়; উপবৃত্তি ১০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বছরের শুরুতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাসামগ্রী (খাতা, কলম, স্কুলব্যাগ) কিনতে ৫০০ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। উপবৃত্তির মাসিক ১৫০ টাকা ও শিক্ষাসমাগ্রী বাবদ ৫০০ টাকা দিলে পাঁচ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা দরকার হবে।

কথা এবং কাজের কোন মিল না থাকায় আজ যে কোন দপ্তরে রাজত্ব তৈরি করতে পারছে ছলাকলাবাজরা। আর তাদেরই একজন গণমাধ্যমকে বলছেন- মেয়াদ আরও ২ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে আছে। প্রাথমিক ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে। আশা করি খুব দ্রম্নত সময়ের মধ্যে প্রকল্প পাস হবে। এ সময়টুকুতে উপবৃক্তির যত বকেয়া টাকা হবে তা একসঙ্গে দেয়া হবে। বকেয়া পরিশোধের জন্য শিক্ষার্থীদের তথ্য মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রকল্প পাস হওয়ার মাত্রই দ্রম্নত সময়ের মধ্যে টাকা বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে বলা হলেও বাস্তবতা চলছে ছলাকলার হাত ধরে। যে কারণে হয়তো কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার কলাতুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী রিতা পারভীন বলতে বাধ্য হয়েছেন- অসচ্ছল অভিভাবকদের সন্তানরাই আমাদের স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। উপবৃত্তি বিতরণের ফলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বেড়েছে। ঝরেপড়া কমেছে। কিন্তু তিন মাস ধরে উপবৃত্তির টাকা বিতরণ বন্ধ থাকায় নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেলেও উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ায় খাতা-কলম কিনতে পারছে না। অভিভাবকরা প্রতিদিন স্কুলে এসে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন।

তবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হাত ধরে যতটা না এগিয়েছে সমাজ ব্যবস্থা; পিছিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি। ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ সালে ফের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) গ্রহণ করে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা এলাকার বাইরের স্কুলের অসচ্ছল পিতা-মাতার সন্তানকে উপবৃত্তি সুবিধা দেওয়া হয়। তবে বাস্তবতা হলো- এ বছর ৯ হাজার ৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৩০৯ পরীক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। মোট পরীক্ষার্থীর ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৬ ছাত্র ও ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯ জন ছাত্রী। অর্থাৎ আমাদের মেয়েরা শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে। ১০টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের গড় ৭৩.৯৩ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। একথা সত্য যে, বিগত তিন বছরে এবার পাসের হার সর্বোচ্চ। কিন্তু প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার বাড়লেও বাড়ছে না মানসম্পন্ন ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। শহর এলাকায় দু-চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিলে সারা দেশের, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো ও শিক্ষার মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এ বছর ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৪৮ হজার ৪৫৭। এদের বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত অভিভাবকের সন্তান। শিক্ষার্থীদের জীবনে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার ফলাফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ স্তর অতিক্রমের মাধ্যমে তারা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়। অক্টোবরের প্রথম দিক থেকেই সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে সত্যিকার্থে যদি বলতে যাই তাহলে বলবো- ভর্তি পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের দেশের নানা প্রান্তে ও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ইউনিটের পরীক্ষায় অংশ নিতে ৪ থেকে ৮ বারও যেতে হয়। এতে শুধু শিক্ষার্থী নয়, ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের অভিভাবকদেরও। বেশি সমস্যায় পড়ে নারী শিক্ষার্থীরা। এভাবে সারা দেশ চষে বেড়াতে কোনো কোনো অভিভাবককে লাখ টাকাও গুনতে হয়। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে- ৪-৫-৬ বছর ধরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের কঠিন যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারছে না।

এমন একটা পরিস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, যারা দুর্নীতিবাজ। অন্তত শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে চলুন যাই যাই যুদ্ধে দেশে সুশিক্ষার ধারা অব্যহত রাখার জন্য…

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি