রনাঙ্গে শহীদ মুকুলের স্মৃতি চারণ

0
277

এম.পলাশ শরীফ,মোরেলগঞ্জ থেকে: স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনী, মায়ের কাছে গল্পেরমত মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস শুনেছি। ৭১ এর রনাঙ্গনে শহীদ হয়েছে চাচ্চু খান নজরুল ইসলাম মুকুল। কথাগুলো বললেন পাঁচগাও মাধ্যমিক বিদ্যালয়েল দশম শ্রেণী শিক্ষার্থী আবিদ আতিউল্লাহ(১৬)।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ করে সেদিনটিতে মোরেলগঞ্জ উপজেলার অকুতভয় ২৩জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। তার মধ্যে একজন অন্যতম খান নজরুল ইসলাম মুকুল।
তার স্মৃতি চারনে ঘুরে দেখা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের অজোপাড়া গায়ে একটি গ্রাম মহিষচরনী। স্কুল শিক্ষক মৃত. সোহরাফ উদ্দিন খানের পুত্র শহীদ নজরুল ইসলাম মুকুলের পৈত্তিক বাড়ি। ৮ ভাইবোনদের মধ্যে শহীদ মুকুল মেঝো, বড়ভাই সালাউদ্দিন মন্টু তৎকালিন বিয়ে পাস করে চাকুরি করতেন, সেজো ভাই জহিরুল ইসলাম বাদশা পেশায় শিক্ষক ছিলেন, ছোট ভাই শাহীন খান অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য বর্তমানে খুলনায় বসবাস।
৪ বোনের মধ্যে মেঝো বোন মমতাজ বেগম পাঁচগাও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে করনিক পদে চাকুরি থেকে বর্তমানে অবসর নিয়ে পিতার বাড়িতে বসবাস করছেন। ভাই জহিরুল ইসলাম বাদশার মৃত্যুর পরে স্ত্রী শাহানা ইসলাম একজন পল্লী চিকিৎসক, ছেলে আবিদ আতিউল্লাহকে নিয়ে বসবাস করছেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দিয়ে দেশ মাতৃকার টানে লাল সবুজের পতাকাকে ছিনিয়ে আনতে সেদিন চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ খান নজরুল ইসলাম মুকুল। বৃদ্ধ পিতা মাতাকে বলে গেলেন মা আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনবো আমাদের স্বাধীনতা।
বয়স তখন তার ২২ বছর। সদ্য বিএসসি পাস করে পাঁচগাও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিএসসি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একজন মেধাবী শিক্ষক হিসেবে এলাকায় তার পরিচিত ছিলো খুবই।
কথা হয়, ১৯৭১ সালে সুন্দরবন সাব-সেক্টরে ষ্টুডেন্ট ক্যাম্পের তৎকালিন দায়িত্বরত কমান্ডার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. লিয়াকত আলী খান। শহীদ নজরুল ইসলাম মুকুল সর্ম্পকে তিনি বলেন, ৭১ সালের জুন মাসের শেষ দিকে প্রশিক্ষণ শেষ করে মুকুলসহ ১১জন প্রথম ব্যাজে তৎকালিন সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়া উদ্দিনের সাথে আসেন এদের মধ্যে থেকে ৪জন ক্যাপ্টেন ব্যাগের সাথে চলে যান বরিশালে বাকিরা থেকে যান আমাদের ষ্টুডেন্ট ক্যাম্পে।
নজরুল ইসলাম মুকুল সার্বক্ষনিক জিয়াউদ্দিনের নির্দেশনা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত ও অপারেশন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেদিন ১৫ আগষ্ট বেলা ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে এসিলাহা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাকাজার ক্যাম্পে অপারেশনের নির্দেশনা। কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নের্তৃত্বে শহীদ আসাদুজ্জামান, শহীদ মুকুল, লিয়াকত আলী খানসহ ৩০ জনের একটি টিম এ অপারেশন পরিচালনা করবেন।
৩টি গ্রুপ তিন দিক থেকে একই দিনে স.ম. কবীর আহম্মেদ মধু’র নের্তৃত্বে বাজারে রায়দের ভবন, সুকুমার সাহার ভবন রাজাকার ক্যাম্প এবং বারইখালীতে আব্দুল হাই খোকন ও সামছুল আলম তালুকদারের নের্তৃত্বে ইউনিয়ন পরিষদের পাক সেনাদের ক্যাম্পে আক্রমন। কুঠিবাড়ির এলাকার দক্ষিণ দিক থেকে এসিলাহা স্কুলে রাজাকার ক্যাম্পে প্রথম আক্রমন শুরু হয়।
৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খান নজরুল ইসলাম, শহীদ আসাদুজ্জামান ও সোহরাফ হোসেন কাবারিং ফায়ার দিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে উঠে যায়। এ সময় ভবনের পিছন থেকে গ্রেনেড চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এ গ্রেনেডের একটি স্পীড এসে মুকুলের পায়ে লাগে সে গুরুত্বর জখম হয়। পরবর্তীতে তাকে নৌকায় করে একজন ফোর্স দিয়ে সুন্দরবন কাম্পে নিরাপদ স্থানে পাঠানো হয়। ক্রমানয়ে তার অবস্থা অবনতি হলে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে আব্দুর রহমান ও নজির মাঝির নৌকায় করে মুকুল ও সরনার্থি জখমী নমিতা সাহাকে একটি নৌকাসহ ৪টি নৌকায় করে ৪শ’ সরনার্থিসহ লিয়াকত আলী খানের নের্তৃত্বে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা স্টকট ফোর্স সহ ভারতের উদ্যোশে রায়মঙ্গল পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সেক্টর কমান্ডার। দিনটি ছিলো ১৭ সেপ্টেম্বর। শ্যালা নদী অতিক্রম করে সম্ভাবত সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ করে টহলরত গানবোর্ড আসতে দেখে ৪টি নৌকা সুন্দরবনের খালের ভিতরে প্রবেশ করে সরনার্থিরা কুলে উঠে যায় কিন্তু গুরুত্বর জখমী মুকুল ও নমিতা আর উঠতে পারেনি। পাক সেনারা নৌকায় এসে প্রথমে নমিতাকে ব্রাস ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং শহীদ নজরুল ইসলাম মুকুলকে তাদের গানবোর্ডে নিয়ে নদীর একটি কিনারায় দীপে বসায় কিছুক্ষন পর পরই উপর থেকে হেলিক্যাপ্টার যোগে টহলরত পাক সেনারা ফলো করতে থাকে। মুকুলকে কেউ উদ্ধার করতে আসেনি। দীর্ঘক্ষণ পরে নদীতে জোয়ার এসে যায়, এ সময় গানবোর্ডটি পুনরায় মুকুলেল কাছে গিয়ে প্রথমে দু’ হাতে পরে দু’পায়ে গুলি কওে জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় এরপরেও অনেক সময় ধরে মুকুল জীবিত ছিলো। তার কান্নায় অর্তনাথ কে কোথায় আছে বাচাঁও আমি বেচে আছি। এ ভাবে কিছু সময় যেতে না যেতেই আর কোন কান্নার শব্দ সুনতে পাইনা আমরা। অসহায়ের মত ৭ জন মুক্তি ফোর্স গাছের আড়ালে বসে দেখতে পাচ্ছি, সহযোদ্ধা মুকুলকে কিভাবে ওরা হত্যা করছে। কিছুই করার নেই তাদের ভারি অস্ত্রের কাছে আমরা শূন্য। মুকুলের মরদেহটিও ফিরিয়ে দিতে পারেনি পরিজনের কাছে।
এ সর্ম্পকে কথা হয় মুকুলের ক্লাসের সহপাঠি ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক মজুমদারের সাথে তিনি জানান, মুকুলে তাদের সহপাঠিদের মধ্যে একজন মেধাবী ছাত্র ছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলো। কিন্তু সে আর ফিরে এলোনা। বর্তমান সরকার প্রথমে ক্ষমতায় আসার পরে তার শহীদ নজরুল ইসলাম খানের পিতা শহীদ পরিবারের পিতা হিসেবে সম্মানি ভাতা পান। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পরে আর কেউ ভাতার আওতায় আসেনি।
এদিকে মুকুলের পৈত্তিক ভিটায় বসবাসকৃত তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী শাহানা ইসলাম বলেন, একজন শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছেলে মেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সম্মানের সহিত একটু সচ্ছলভাবে বসবাস করা, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। লেখাপড়া শেষ করে পরবর্তীতে ছেলেমেয়েদের চাকুরি কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা একজন মাতা হিসেবে।