যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব কি বাংলাদেশের চামড়ার বাজারে ?

0
476

খুলনাটাইমস অনলাইন ডেস্কঃ ফরিদপুরের ব্যবসায়ী মোঃ. আমিন পনেরো বছর ধরে কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করছেন। কিন্তু এ বছরের মতো এতটা ক্ষতি আর আর আগে হয়নি। কেনা দামও না পাওয়া তিনি এখনো অনেক চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না।মোঃ আমিন বলছেন, ”ওনারা যে রেটে দর দিয়েছেন, তাতে তো কিছু কেনাও যায় না, বিক্রিও করা যায় না। একেকটা চামড়ার দাম পড়ে পাঁচশো টাকা-ছয়শ টাকা। বড় চামড়া হলে সর্বোচ্চ একহাজার টাকা হয়।

”কিন্তু একজন শ্রমিকের বেতনই আছে একহাজার টাকা। তার সঙ্গে লবণ আছে, পরিবহন খরচ আছে। এতো খাটাখাটি করে আমাদেরও কিছু লাভ করতে হয়। এরপরে আর কিছু তো থাকেই না, বরং লোকসান হয়ে যাচ্ছে। সামনের বছর আর চামড়ার ব্যবসা করবেন কিনা, এখন সেটি নিয়েও তিনি ভাবতে শুরু করেছেন। একই কথা বলছেন বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রামের খুচরা ব্যবসায়ীরাও।

কেন কমছে চামড়ার দর?

বাংলাদেশে মোট চামড়ার চাহিদার ষাট শতাংশই কোরবানির ঈদের সময় সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে কোরবানির পর এখন চলছে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া, তবে এ বছর কাঁচা চামড়ার দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বলে বলছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেনা দরও না পাওয়ায় তারা বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।গত কয়েক বছর ধরেই কাঁচা চামড়ার দাম কমতির দিকে রয়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০১৪ সালেও প্রতি বর্গফুট লবণ দেয়া চামড়া বিক্রি হয়েছে সরকার নির্ধারিত ৭৫ টাকা দরে, যা এ বছর এসে দাঁড়িয়েছে ৪৫টাকা দরে। লবণ ছাড়া চামড়ার দর ৩০/৩৫টাকা। অর্থাৎ তখনকার গরুর একটি দুই হাজার টাকা দামের কাঁচা চামড়া এখন তাদের বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় অর্ধেক মূল্যে, ঢাকার বাইরে দর আরো কম।

খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে কম দামে চামড়া কিনছেন। আর তাদের চাপে সরকার চামড়ার কম দাম ধরতে বাধ্য হয়েছে।কিন্তু বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ দায়ী করছে বিশ্ব অর্থনীতিকে।

মি. আহমেদ বলছেন, কাঁচা চামড়ার দাম কমার কয়েকটি কারণ রয়েছে। চামড়ার দামের বেঞ্চ মার্ক হচ্ছে আমেরিকা। সেখানে যদি দাম কমে, তাহলে সারা বিশ্বেই দাম কমে। এ কারণে আমাদের দেশেও গত দুইবছর ধরে চামড়ার দাম কমার দিকে রয়েছে। ”

তিনি বলছেন, ”আরেকটি কারণ হলো, চামড়াটা আমাদের দেশ থেকে চীনের ক্রেতারা কিনে নিয়ে পণ্য বানিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করে। কিন্তু চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে আমেরিকা চীনের পণ্যের ওপর যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, সেটার প্রভাব বাংলাদেশের চামড়া শিল্পেরও ওপর পড়েছে।

কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত দুইবছর ধরে আমাদের কাছ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে আমাদের দেশের চামড়ার যে চাহিদা ছিল বিদেশের বাজারে, সেই চাহিদা দিন দিন কমছে,” বলছেন মি. আহমেদ।বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মাত্র পৌনে তিনকোটি, বাকিটা রপ্তানি হয়।

বিশ্ববাজারে মন্দার কারণে বাংলাদেশের চামড়ার দাম কমছে বলে বলছেন ব্যবসায়ীরাবিশ্ববাজারে মন্দার কারণে বাংলাদেশের চামড়ার দাম কমছে বলে বলছেন ব্যবসায়ীরা

সমাধানের পথ কী?

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ায় পশু কোরবানির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থা পাল্টায় নি, আর মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, চামড়ার যে দাম কমেছে, মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করলে সেই পতন আসলে আরো বেশি হবে। চামড়া মালিকদের কাছে আগের স্টক থাকা, বৈশ্বিক দর পতন, রপ্তানির শ্লথগতি – নানা কারণ রয়েছে।তিনি বলছেন, সেজন্য আধা-প্রক্রিয়াজাত চামড়ার যে বাজারগুলো বিশ্বে রয়েছে, সেদিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

”এখন যে প্রক্রিয়ায় চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয়, তাতে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধার বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্তু তাতে তারা সাময়িক লাভবান হলেও আসলে বেশি লাভ হয় না। কারণ সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চামড়া সংগ্রহের কোন চেইন গড়ে ওঠে না। তাই চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরো সাপ্লাই চেইনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত। মনে রাখা দরকার, চামড়ার একটি সক্রিয় বাজার-সেটা দেশে হোক আর বিদেশে, তা যতটা সচল থাকবে, তখন এর সংগ্রহ, মূল্য বা ব্যবহারে সব পক্ষ লাভবান হবে।বুধবার থেকে এ বছর কোরবানির চামড়া সংগ্রহ শুরু হলেও এখনো অনেক খুচরা ব্যবসায়ী তাদের সংগ্রহ  করা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের এলাকা থেকে এখনো মূল চামড়া বাজার পোস্তা এবং সাভারের উদ্দেশ্যে চামড়া আসছে।কিন্তু ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকার এবং কারখানা মালিকরা যে দাম বলছেন, তাতে তাদের শ্রমিক মজুরীও উঠবে না।ফলে সীমান্ত পথে কাঁচা চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার আশংকাও করছেন অনেকে। সূত্র- বিবিসি বাংলা