মোড়েলগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলছে অপারেশন ও প্রাইভেট বাণিজ্য

0
303

এম.পলাশ শরীফ, মোড়েলগঞ্জ:
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে প্রায় ৫ লক্ষ জনগনের একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটি এখন পরিনত হয়েছে প্রাইভেট হাসপাতালে। সরকারি নিয়ম-নিতীর তোয়াক্কা না করে সরকারি এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে চিকিৎসা নিতে হয় ফি দিয়ে ও অপারেশন করাতে হয় চুক্তিভিত্তিক অর্থের বিনিময়। টাকা ছাড়া এখানে রোগীদের চিকিৎসা গ্রহন ও অপারেশনের কোন সুযোগ নেই। কর্মরত ৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে অধিকাংশই থাকেন অনুপস্থিত। সরজমিনে গত কয়েকদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘোরাঘুরি করলে নজরে আসে হাসপাতালের এ ভয়াবহ চিত্র। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মুফতি কামাল হোসেন-এর অনেকবার বদলীর আদের্শ হলেও উপরের তদবিরে আবার ফিরে আসে নিজ কর্মস্থলে।

শুক্রবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে কথা হয় টিউমার অপারেশন করতে আসা পার্শবর্তী ইন্দুরকানী উপজেলার শেওতী বাড়িয়া গ্রামের ভিক্ষা করে জীবীকা নির্বাহকারী বৃদ্ধা আলেয়া বেগমের সঙ্গে তিনি জানান, অপারেশনের জন্য ডাক্তারকে ২ হাজার টাকা দিতে হবে। ভিক্ষা করে দিন চলে এ কথা বললেও ডাক্তারের মন গলেনি। অবশেষে মানুষের কাছে চেয়ে-চিন্তে জাকাত ফেতরার টাকা মিলিয়ে ২ হাজার টাকা জোগার করে তা নিয়ে অপারেশন করতে এসেছেন। বৃহস্পতিবা হাসপাতালে গিয়ে কোন ডাক্তারকেই পাওয়া গেলেনা। আগত রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন জিহাদুল ইসলাম নামে একজন স্বাস্থ্যসহকারী।
সোমবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে কর্মরত ৫ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে পাওয়া গেল ডা. মুফতি কামাল হোসেন, ডা. শাহজালাল, ডা. লিমা ইয়াসমিন নামে তিন জনকে। কর্মরত অন্য ২ মেডিকেল অফিসারই অনুপস্থিত। তারা কোথায় আছেন তাও জানেন না উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাক্তার মুফতি কামাল হোসেন। উপস্থিত ৩ চিকিৎসক নিজ নিজ চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন। এর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাক্তার মুফতি কামাল হোসেন তার চেম্বার ছেড়ে ডাক্তারদের চেম্বারে বসে জন প্রতি ২শ টাকা করে ফি নিয়ে রোগী দেখছেন। এ হাসপাতালে রয়েছে বেশ কয়েকজন দালাল। দালালরাই রোগীদের সিরিয়াল দিচ্ছেন। কেউ আবার রোগীর হাত ধরে চেম্বারে প্রবেশ করাচ্ছেন। কেউ আবার টাকা রাখছেন। হাসপাতালের নার্সরা একত্রে বসে খোসগল্পে মত্ত। নিমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ন্যাবুলাইজার দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। যদিও এ সব স্বজনদের ন্যাবুলাইজার দেয়ার নেই কোন অভিজ্ঞতা। হাসপাতালের ভেতরে নিরাপদে ঘুমুচ্ছে তিনটি কুকুর। তারা নাকি আবার হাসপাতালেরই নাইটগার্ড।
হাসপাতালের ২য় তলা ঘুরে দেখা গেল অসংখ্য অপারেশনের রোগী। এসব রোগীকে সাধারণ কক্ষে না রেখে রাখা হয়েছে আলাদা ৩ টি কক্ষে। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের অপারেশন হয়েছে টাকার বিনিময়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পরিশোধের পরই তাদের অপারেশন সম্পন্ন করা হয়। অপারেশনের একাধিক রোগির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চুক্তি অনুযায়ী আ্যপেন্ডিক্স অপারেশন করা হয়েছে উপজেলার গোয়ালবাড়িয়া গ্রামের সুমনা(১০), কালিকাবাড়ি গ্রামের সাব্বির হাওলাদারের স্ত্রী ঐশি আক্তার (২০), পিসি বারইখালী গ্রামের ইব্রাহিম কাজীর স্ত্রী সাথী আক্তার (১৮), কাঠালতলা গ্রামের শহিদুল হাওলাদারের মেয়ে আমেনা (১৮), সোমাদ্দারখালী গ্রামের খোকন হাওলাদারের মেয়ে সুমাইয়ার (১২)। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে অপারেশন বাবদ নেয়া হয়েছে ২হাজার ৫শ টাকা করে ।
হোগলাবুনিয়া গ্রামের আঞ্জিরা বেগমের(৪৫) পাইলস অপারেশন করা হয়েছে ৪ হাজার টাকার চুক্তিতে, ইন্দুরকানী উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের রুহুল আমীনের স্ত্রী মাকছুদা বেগমের পাইলস অপারেশন করা হয়েছে ৫ হাজার টাকা চুক্তিতে,একই উপজেলার বালিপাড়া গ্রামের মো. ইদ্রিস হাওলাদারের মেয়ে সুমি (১৮) এ্যাপেনডিস অপারেশন করেছেন ৩ হাজার টাকার চুক্তিতে, নিমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে জিউধরা গ্রামের সোহেল রানার ছেলে রবিউল ইসলাম (১০ মাস), তার নিমোনিয়া চিকিৎসা ও মুসলমানি করার জন্য চুক্তি করে নেয়া হয়েছে ১হাজার ২শ টাকা ।
এ ধরনের অন্তত ২০ জন অপারেশনের রোগীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, অপারেশনের পূর্বে চুক্তি করে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করার পরেই তাদের অপারেশন করা হয়েছে। আর তাদের অপারেশন করেছেন ডা. মুফতি কামাল হোসেন একাই। অপারেশন চলাকালীন ওটিতে অন্য কোন ডাক্তারকে তারা দেখেননি, অপারেশনের পর থেকে নার্সরা এসে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এ হাসপাতালটিতে অনিয়মই নিয়মে পরিনত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।
চুক্তিভিত্তিক অর্থের বিনিময় অপারেশনের বিষয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডা. মুফতি কামাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে, এ বিষয় কথা বলার জন্য তিনি বিকেলে তার বাসায় আমন্ত্রন জানান।
টাকা নিয়ে অপারেশন করার বিষয় জেলা সিভিল সার্জন ডা. জি,এম শামসুজ্জামান এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তার জানানেই। অনিয়ম থাকলে তার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন।