মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে ওয়েষ্টান গ্রুপের বিনিয়োগ এখন খুলনার পার্ক ও হোটেলে

0
842

সুমন আশিক: মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি নিয়ে চলছে হরিলুট। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স ২০ তলা করার কথা থাকলে ১১ তলা করে লাপাত্তা হয় ওয়েস্টার্ন গ্রুপের ডেভেলপার কোম্পানী ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। এতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে ট্রাষ্ট। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ী প্রতিষ্টানটি বর্তমানে ঘাঁটি গেড়েছেন খুলনায় রিসোর্ট ব্যবসায়। নির্মাণ করেছেন অত্যাধুনিক এমিউজমেন্ট পার্ক ও নির্মানাধীন রয়েছে পাঁচ তারকা মানের হোটেল। রানা রিসোর্ট এন্ড এমিউজমেন্ট পার্কটি ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার খুলনাটাইমসকে বলেন, ট্রাষ্ট ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই ভবনটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য ডেভেলপার কোম্পানীকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে এখনও নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ ইফতেখারুল ইসলাম খান খুলনাটাইমসকে বলেন, ডেভেলপার কোম্পানী ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স এর সাথে ট্রাস্টের চুক্তি হয়। তবে তারা চুক্তি অনুযায়ী ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেনি। নানা উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রত্তুত্তরে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান এর কাছে জিজ্ঞেস করুন। তিনি বলতে পারবেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নিজেই এর দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি তার কাছ থেকে জেনে নেন।
ট্রাষ্টের কর্মকান্ডে সংসদীয় কমিটি হস্তক্ষেপ করতে পারে কি-না? এমন প্রশ্নে তিনি কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
মোঃ ইফতেখারুল ইসলাম খান জানান, ১৯৯৬ সালে ডেভেলপার কোম্পানী ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সেও সাথে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজের চুক্তি করে তৎকালীন ট্রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আসাদুজ্জান। স্বাভাবিক ভাড়া ১৫০ প্রতি বর্গস্কায়ার ফিট। তবে চুক্তি কারণে ভাড়া পাচ্ছি প্রতি বর্গস্কায়ার ফিট ৬ টাকা উপরতলাসমূহের জন্য এবং ১০ টাকা নীচতলা সমূহের জন্য। তাও সবাই দেয় না। একটা বড় অংশই দখল করে রেখেছে প্রভাবশালী মহল। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ডেভেলপার কোম্পানীর কাছ হতে অন্তত: ২২৫০ কোটি টাকা পেতো ট্রাষ্ট। তবে তা হয়নি। এত বিপুল অংকের অর্থ হারানোর জন্য ডেভেলপার কোম্পানীই দায়ী। তিনি যোগদানের পর প্রজেক্টটির বার্ষিক আয় ৮ কোটি থেকে ৫০ কোটিতে উন্নীত করেছেন বলে জানান।
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক নৌ পরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খান খুলনাটাইমসকে বলেন, ২০০৯ সালের সংসদীয় কমিটির সভাপতি থাকাকালীন এবিষয়টি অবগত হই। তখন আমাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তবে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এখন পুনরায় আমি সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি সেখানে আমাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে কতিপয় ব্যাক্তি সেখানে বেজমেন্ট দখল করে রেখেছে। এরপর আমি ডেভেলপার কোম্পানীকে খুজে বের করি এবং এবিষয়ে জানতে চাই। তখন ওয়েষ্টার্ন গ্রুপের কর্ণধার দাবি করেন, একটি মহল ভয়ভীতি দিয়ে তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে। আমি তাদের অভয় দিয়ে ভবনটি দ্রুত নির্মাণ সম্পন্নের পদক্ষেপ নিতে বলেছি।
ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপের পরিচালক (ফিন্যান্স) মোঃ রায়হান উদ্দিনের কাছে শুক্রবার মুঠোফোনে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি খুলনাটাইমসকে নিশ্চিত করেন, ২০ তলা ভবন ‘গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’র সাথে তারা চুক্তিবদ্ধ হন এবং ১১ তলা নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এরপরই তৎকালীন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজ্ঞাত কারণে তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখেন। তিনি দাবি করেন, এখনও ট্রাস্টের কাছে তাদের দুই কোটি টাকার বেশি পাওনা আছে। এছাড়া এই নির্মাণ কাজে ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপ ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এজন্য কোম্পানী ট্রাস্টের বিরুদ্ধে আরবিটেশন মামলা করেছে, যা এখনও চলমান।
ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঁইয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে কথা হয় দ্যা ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অপর পরিচালক সাইফুল ইসলাম এর সাথে। তিনি খুলনাটাইমসকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছে। এবিষয়ে জটিলতা নিরসনে ট্রাষ্ট ও সংসদীয় কমিটি উদ্যোগ নিয়েছে এবং তাদেরকে ভবনটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তিনি দৃঢ়কন্ঠে বলেন, একটি প্রভাবশালী মহলের চাপে নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখে চলে যেতে বাধ্য করা হয় তার কোম্পানীকে।
তবে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অরগানাইজেশনের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন জানান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যোখানে দূনীতি বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছেন। সেখানে এই বিএনপি ও জামায়াত কানেকশন নেতা কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পদ হরিলুট করে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ব্যবসা করে এখন খুলনায় রিসোর্ট ব্যবসা শুরু করেছে কিভাবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ আমলে নেবেন বলে আমি মনে করি।
মুক্তিযোদ্ধা মুনছুর খান জানান, প্রধানমন্ত্রী সর্বদা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি থাকতে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেতা এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বে তিনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ হরিলুট করে এবং দূর্নীতি করে দাপটের সাথে সমাজে চলাফেরা করছে।
সূত্র বলছে, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হওয়ার পর এই কোম্পানী নতুন করে বিনিয়োগ করছেন ট্যুরস এন্ড ট্যুরিজম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। প্রথমে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে এখন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বরণপাড়ায় ৯.২৫ একর জায়গা নিয়ে গড়েছেন রানা রিসোর্ট এন্ড এমিউজমেন্ট পার্ক। এক দিকে লাপাত্তা অন্য দিকে শুক্রবার দুপুরে জাকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিজ পুত্রের নামে গড়ে তোলা রানা রিসোর্ট এন্ড এমিউজমেন্ট পার্ক এর উদ্বোধন করেন। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে কৌতুহল থাকলেও এখন বের হয়ে আসছে এই বিএনপি নেতার মালিকানাধীন ওয়েষ্টার্ণ গ্রুপের নানা অনিয়মের তথ্য। স্থানীয় ভাবে লোকদের কর্মসংস্থানের দোহাই দিয়েই মূলত এখানে প্রমদ বিলাসীদের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন।
সূত্রমতে, রাজধানীর গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স ৬১৪ শতাংশ এই জমির মালিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। এই জায়গায় ২০ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ না করে উধাও হয়ে গেছে ডেভেলপার কোম্পানি। ভবনটির ১১ তলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষে সব ফ্লোর ও দোকান বিক্রি করে সটকে পড়ে কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সাবেক সহ-সভাপতি এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঁইয়ার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দ্য ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান গুলিস্তানের এই সম্পত্তির ওপর ২০ তলা ভবন ‘গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করতে ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে এক ‘অসম’ চুক্তি করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। চুক্তি অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের পর সব ফোর বিক্রি করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আর কল্যাণ ট্রাস্ট পাবে দোকান ক্রেতার কাছ থেকে মাসিক ভাড়া। কিন্তু বর্তমানে যে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে ভবনটির তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভবনের ফোরগুলো বিক্রি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যান ডেভেলপার কোম্পানির মালিক ও বিএনপি নেতা এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঁইয়া।
জানা গেছে, ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে কল্যাণ ট্রাস্টের চুক্তি হয়। গুলিস্তান সিনেমা হলের ওই প্লটে জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৬১৪০ একর। চুক্তির দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করে তা কল্যাণ ট্রাস্টকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। পরে দুই ধাপে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সে অনুয়ায়ী ২০০৭ সালের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক এ এস এম আলাউদ্দিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠতে থাকায়, তিনি পালিয়ে যান। এর পর আর ভবনের নির্মাণ কাজ এগোয়নি।