মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে

0
421

গৌরবময় মহান বিজয় দিবস আজ । ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দখলদার পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয়। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের এই স্বাধীনতা। তবে বিজয়ের এই দিনটি আমাদের জন্য যেমন আনন্দের তেমনি একইসঙ্গে বেদনারও, বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের জন্য।

আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের; যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের। যে অগণিত শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল, আমরা তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমরা একই সঙ্গে স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতাদের। এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোটি কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন।

নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই বিজয় দিবস আমাদের জন্য আরও বেশি অর্থবহ। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কিন্তু ৪৬ বছরের এ পথপরিক্রমায় আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই মোকাবেলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা ছিল ধর্ম–বর্ণ–জাতি ও নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সম–অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু সেই প্রত্যয় থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনায়।

দেশকে উন্নতি সোপানে এগিয়ে নিতে সদ্য স্বাধীন দেশের নেতৃত্বের অঙ্গীকারের অভাব ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, পরবর্তী সময়ে এক্ষেত্রে মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে এবং তার খেসারত দিতে হয় জাতিকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য এখনও প্রকট। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেও আজও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হতে পারেনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর বিভক্তি; এর পাশাপাশি জাতীয় প্রশ্নে অনৈক্য আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে। এছাড়া দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তৎপর এখনও। তবে আশার কথা, যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে এবং বেশ কয়েকটি রায় কার্যকরও হয়েছে। বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে তা এ ধরনের অপশক্তির তৎপরতা রোধে সহায়ক হবে।

তবে এ কথা সত্য, ৪৬ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়েছে দেশ। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকেও অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশি অগ্রগতি আমাদের। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকারঅনেকে। তাই অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধ রক্ষায় হতে হবে যতœবান। তবেই বিজয় হয়ে উঠবে অর্থবহ।

স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হবে আমাদের উত্তর প্রজন্মকে। এ বিজয় এমনি এমনি আসেনি। এর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়েছে, অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের এই জায়গায় পৌঁছতে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ। এজন্যই সম্ভব হয়েছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত করা। একটি জাতির শক্তির প্রধান উৎস ঐক্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতির জন্য এ ঐক্যের প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার পর আমরা সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি। যা গণতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করার পথে অন্তরায়।

রাজনীতিতে পথ ও মতের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু সেটি কখনোই সংঘাত সৃষ্টির কারণ হতে পারে না। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের নেতৃত্বকে। সেই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় অভিন্ন নীতি অনুসরণ অপরিহার্য। আমাদের সামনে অফুরন্ত সম্ভাবনা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হলে আমাদের দ্রুত অগ্রগতি ঘটবে। মুক্তযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে সবাই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখবে- বিজয় দিবসে এমনটিই প্রত্যাশা আমাদের।