ভাষা সৈনিক বঙ্গবন্ধু

0
479

নাসরীন জাহান লিপি:
দাম দিয়ে কিনেছি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আর তাই ইতিহাস ভুলিনি। ভুলিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক অদ্ভুত দেশটির জন্ম হয়েছিল দু’টি অংশে ভাগ হয়ে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশ আর পশ্চিম অংশের মাঝখানে আরেক দেশ ভারত। ৫৬ ভাগ জনসংখ্যার বাস পূর্ব অংশে। অথচ পাকিস্তানের রাজধানী হ’ল পশ্চিম অংশে। সুজলা সুফলা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ লুট করে ফুলে ফেপে উঠছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সৌভাগ্য। বাঙালিদের উপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতেও শুরু হয়েছিল বৈষম্য-অবিচার। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে মাস্টার্সে পড়তে শুরু করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান নামের এক তরুণ ছাত্র। অন্য অনেকের মতো চুপ থাকতে পারেননি তিনি। শুরু করেন প্রতিবাদ। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর উপর কড়া নজর রাখতে শুরু করে তখন থেকেই। প্রায়ই কারাবন্দী হতে হয়েছে। তবুও দমে যাননি তিনি। ১৯৪৮ সালের শুরুর দিকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মুখের ভাষা, বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আজন্ম মাতৃভাষাপ্রেমী শেখ মুজিবুর রহমান নানা কৌশলে বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা মার্চ তারিখের গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান, সান অব লুতফর রহমান অব টুঙ্গিপাড়া, ফরিদপুর এন্ড স্টুডেন্ট ফার্স্ট ইয়ার বি এল ২১ দফা দাবিসহ একটি লিফলেট বিতরণ করছিলেন, যেখানে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হ’ল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না।” দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আসলে ইসলামের কথা বলে ধর্মভীরু মুসলমানদের ধোঁকা দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। বিষয়টি বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের। বাংলা ভাষাভাষি বাঙালিদের সময় লাগেনি বুঝতে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস গড়ে তুলেছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’। পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হ’ল ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সাল। ভোরবেলা থেকে শত শত ছাত্রকর্মী নেমে এলেন পথে। সবার সামনে ছাত্রনেতা মুজিব। জিপিও’র সামনে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে আহত হলেন অনেকে। বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পৃষ্ঠা-৯৩) এভাবে আর কতক্ষণ? তরুণ শেখ মুজিবসহ বহু ছাত্র গ্রেফতার ও জখম হলেন। এর দু’দিন পর জেলখানায় দানা বেঁধেছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র। নিষ্ঠুরতার জন্য জেল সুপারিনটেন্ড মি. বিল-এর কুখ্যাতি ছিল। ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দিদের উপর গুলি করে কয়েকজন দেশপ্রেমিককে হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিল এই লোক। বাংলা ভাষার দাবিকে দমন করতে প্রতিবাদী বন্দি ছাত্রদের ভয় দেখানোর পরিকল্পনা করলেন মি. বিল। ঠিক হ’ল, ওয়ার্ডের দরজা খুলে সিপাহীদের নিয়ে ভেতরে ঢুকে বন্দী ছাত্রদের মারপিট করবে জেলখানার জমাদার। বুঝতে পেরেছিলেন মুজিব। সাবধান করে দিলেন সবাইকে। ডিউটিতে থাকা বাঙালি সিপাহীও সাহায্য করলেন। চাবি নিয়ে কেটে পড়লেন। ষড়যন্ত্র সফল হ’ল না। প্রাণে বেঁচে গেলেন ছাত্ররা। ১৫ই মার্চ মুক্তি পেলেন মুজিব। এরপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন তিনি ছড়িয়ে দিলেন ঢাকাসহ সারা দেশে। ফলে কেবল ছাত্ররাই নয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পরিণত হ’ল গণ দাবিতে। ষড়যন্ত্রের শেষ চেষ্টা হিসেবে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম জিন্নাহ্ এলেন ঢাকায়। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান, বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দিলেন, “উর্দু এন্ড উর্দু অ্যালোন উড বি দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য স্টেট অব পাকিস্তান”। অর্থাৎ, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। উপস্থিত জনতা সমস্বরে জানিয়ে দিলেন, ‘মানি না!’ এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বর্ক্তৃতা করতে উঠে তিনি আবারও বললেন কথাটি। ছাত্ররা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘নো নো নো’। “জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বর্ক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তাঁর মুখের উপরে তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। তারপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোনদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে)
-২-
মুসলিম লীগ সরকার ক্ষেপে গেল। যে কোনো অজুহাতে শুরু করেছিল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার, জেল-জুলুম-জরিমানা। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকে সমর্থন করাতে বন্দী হলেন মুজিব। বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কার করে তাঁকে। অনেকেই মুচলেকা ও জরিমানা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পান। শেখ মুজিব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, “আমি কোনো অন্যায় দাবি করি নাই, অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত দাবি করেছি। মুচলেকা ও জরিমানা দেওয়ার অর্থ হলো দোষ স্বীকার করে নেওয়া আমি তা করব না।” ১৯৫২ সাল। তখনো শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বন্দী। নানান কৌশলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে গতিশীল করতে নানা কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশনা দিতেন কারাগার থেকে। জেলখানা থেকে চিরকুট পাঠাতেন, আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখতেন। সরকার টের পেয়ে তাঁকে ফরিদপুর কারাগারে সরিয়ে নেয়। স্থানান্তর হওয়ার পথেও তিনি নারায়ণগঞ্জে নেতাকর্মীদের ভাষা আন্দোলনে কী করতে হবে, তার নির্দেশনা দিয়ে যান। বন্দী মুজিব প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে দাবী জানান, যদি ১৫ই ফেব্রæয়ারির মধ্যে মুক্তি দেওয়া না হয়, তাহলে ১৬ই ফেব্রæয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট পালন করতে শুরু করবেন। “ঊরঃযবৎ ও রিষষ মড় ড়ঁঃ ড়ভ ঃযব লধরষ ড়ৎ সু ফবধফনড়ফু রিষষ মড় ড়ঁঃ.” (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে)
মুক্তি পেলেন না। গোয়েন্দারা সরকারকে জানালেন, ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিফলেট। ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন অনশন ধর্মঘট করছেন। তাঁদের মুক্তির দাবীতে রাজপথে নেমে এসেছে সাধারণ মানুষ। তবুও মুক্তি পেলেন না। অনশনের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় গোপনে ছাত্রলীগের সভাপতি নইমুদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ দেখা করলে ২১শে ফেব্রæয়ারি তারিখে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন বিষয়ে আলোচনা করলেন। পালিত হ’ল ২১শে ফেব্রæয়ারি। ১৯৫২ সালের সেই ২১ শে ফেব্রæয়ারি, ভাইয়ের বুকের তাজা রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রæয়ারি, যেদিন ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি করে বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায় পাকিস্তানের পুলিশ। রক্তাক্ত শরীরে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার ও আরও অনেকে। ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করেন বাংলার সন্তান। সেদিন বঙ্গবন্ধুর মনের অবস্থা কেমন ছিল? ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “২১শে ফেব্রæয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহীরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে।” “খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।” বিক্ষুব্ধ জনতার দাবির মুখে ২৭শে ফেব্রæয়ারি তারিখে মুক্তি দেওয়া হ’ল বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি আবারো শুরু করলেন সারা দেশ ঘুরে ভাই হত্যার প্রতিবাদ, কণ্ঠে তাঁর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সাথেও দেখা করেছেন। ১৯৫২ সালের ৩০শে মে তারিখে করাচিতে এক সভায় তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানানোর পাশাপাশি সরকারের দুর্নীতি এবং পাট চাষীদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে সমর্থন জানিয়ে ভাষণ দেন বলে গোয়েন্দা রিপোর্ট করা হয়। দিনের পর দিন ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকারের দাবিতে একাত্ম হয়েছিল বাঙালি। নেতৃত্বের গুণেই সেদিনের সেই তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমশঃ হয়ে উঠলেন বাঙালির বন্ধু বঙ্গবন্ধু। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করা হয়েছিল তা-ই পরবর্তী সময়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অপরিসীম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাঙালি সার্থক করে তোলে বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিলেন, অফিসের কাজে বাংলাভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিলেন মাতৃভাষা বাংলাতেই। বায়ান্ন’র ভাষা শহিদ সালাম-রফিক-বরকতের রক্তের ঋণ শোধ হ’ল, সারা বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে বিজয়ের বেশে দাঁড়ালো আমার ভাষা বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার মহান সৈনিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান বাংলা ভাষাভাষি মানুষ কখনোই ভুলবে না। ভুলতে পারে না।