মিঠুন সরকার :
ভারতের প্রাক্তন এবং অন্যতম সফল প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপাই বলেছিলেন, “আমরা চাইলে আমাদের বন্ধু বদলাতে পারি কিন্তু প্রতিবেশী নয়।” সুতরাং যারা ভাবছেন ভারতে কে এলো, কে গেল, তাতে আমাদের কি? ব্যাপারটা পুরোপুরি ঠিক নয়। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকেও সরাসরি প্রভাবিত করে অনেকক্ষেত্রে।
সম্প্রতি ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী পুনরায় নির্বাচিত হয়েছে। এদেশের কিছু মানুষের কমেন্টে দেখলাম তারা বলেছে ভারতের হিন্দুরা মৌলবাদের উত্থান চায়। তারা অসাম্প্রদায়িকতার বিনাশ চায়। তারা সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করতে চায়। ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরি সঠিক নয়। এই ভারতের হিন্দুরাই ৭৩ বছরের স্বাধীনতায় ৬৩ বছরই অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসসহ অন্যান্য দলকে ক্ষমতায় এনেছে।
আসলে ভারতের হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে যেটা চায় সেটা হল পরিবর্তন। অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেস টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতির যে মচ্ছব করেছিল সেটা এখনো মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর আমলে টুজি স্ক্যম, কয়লা কেলেঙ্কারি, কমনওয়েলথ স্ক্যমসহ ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন দুর্নীতি দেখেছিল ভারতের জনগণ। বাদ যায়নি ডিফেন্স বিভাগও। সেখানে অভিষেক ভার্মা অস্ত্রচুক্তি স্ক্যম কিংবা নৌবাহিনীতে বড়ধরনের দুনীর্তির সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িকতা ক্ষমতায় আসার মাপকাঠি হয়না, ঠিক যেমন শুধু হিন্দুত্ববাদ দিয়েও ক্ষমতায় আসা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতা যদি পেটে ভাত আর নিরাপত্তা জোগাতে না পাওে, তাকে মানুষ আঁকড়ে ধরে থাকবে না, আবার হিন্দুত্ববাদও যদি কাজ করে খাওয়ার সুযোগ দিতে না পারে তাহলেও কেউ ধর্মের দুয়োতে ভুলবে না।
তার সবথেকে বড় প্রমাণ হল কিছুদিন আগের হিন্দুত্ববাদের রাজধানী মোদীর নিজের রাজ্যের গুজরাট নির্বাচন। কংগ্রেস এখানে ৮০ টা সিট পেয়ে বিজেপির নেতাদের প্রেসার বাড়িয়ে দিয়েছিল। যদিও ১৯ টা (মোট ৯৯টা) সিট বেশি পেয়ে মোদীর সম্মান কোনরকমে রক্ষা পায়। গুজরাটে ভোটে দেখা গেছে শহরের (উন্নত) ভোট বিজেপি পেলেও গ্রামের(অনুন্নত) ভোট পড়েছে কংগ্রেসে। হিন্দুত্ববাদের সবথেকে শক্তিশালী ঘাটির হিন্দুরাও বেঁচে থাকার অমোঘ সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনি। তাদের বড় একটা অংশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিজেপি থেকে।
নরেন্দ্র মোদী তার বিগত ক্ষমতার পাঁচ বছরে কোন কাজ আশানুরূপ করে দেখাতে পারেননি। অন্তত উনি যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ভারতের মানুষকে তার কিছুই পূরণ হয়নি শুধু হিন্দুত্ববাদ এবং দেশের নিরাপত্তা হুমকিতে আছে এই দুয়ো ছাড়া। তারপরে যুক্ত হয়েছে রাফায়েল চুক্তির অস্বচ্ছতা প্রসঙ্গ। কংগ্রেসসহ অন্যান্য দলগুলো এই ইস্যুতে মোদীকে ভালই বেকায়দায় ফেলতে পেরেছিলেন। কিন্তু পুলাওমাতে জঙ্গি হামলা প্রতিরোধ স্বরুপ পাকিস্তানের এয়ার স্ট্রাইক দিয়ে রাফায়েল ইস্যু খুব ভালভাবেই ধামাচাপা দিতে পেরেছিলেন মোদী। তবুও মানিডিমোনিটাইজেশন, জিএসটি, বেকারত্ব হার বিগত ৬০ বছরে সর্বোচ্চ হওয়াসহ বিভিন্ন ভুল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বিজেপির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারতো।
কিন্তু তারপরেও মোদী একক এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা এইবার ক্ষমতায় এলেন শুধু মাত্র বিরোধী শিবিরে উনার সমপর্যায়ের একজন জাতীয় নেতার অভাবে। মোদীর দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েছেন। তবে গত পাঁচ বছরের ভুলগুলো শুধু এইবার শুধরালেই কাজ হবেনা। করতে হবে দৃশ্যমান উন্নয়ন যা সাধারণ মানুষের অর্থনীতিকে গতিশীল করবে। কিন্তু সামনের পাঁচ বছরেও যদি উনি হেলায় নষ্ট করেন ভারতের জনগন বিজেপিকে জাস্ট ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এইবারের নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদ আর সাধারণ হিন্দুদের ধর্মপ্রীতি আদৌ ততটা কাজ করেনি। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীসহ অন্যান্য নেতার অকর্মণ্যতা আর ঢিলামি ছিল অন্যান্য যেকোন লোকসভা নির্বাচনের থেকে ছিল নজিরবিহীন যেটা বিজেপির জয়ের অন্যতম মূল কারণ।
আরেকটি ব্যাপার নন-বিজেপি দলগুলো নরেন্দ্র মোদীকে গালি না দিয়ে যদি জনসংযোগে একটু মনোযোগ দিত তাহলেও হয়তো তাদের কিছু আসন বাড়তে পারত। তাদের প্রত্যেকের ছিল কৌশলগত ভুল। তারা তাদের ভাষণে জনগনের জন্য কি করবে এটা উপস্থাপন করার থেকে আরও কি তীর্যক ভাষায় মোদীকে আঘাত করে যায় সেদিন বেশি সময়ক্ষেপণ করেছে। যেমন রাহুল গান্ধী বলেছেন চৌকিদার চোর কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল দলের সুপ্রিমো বলেছিলেন, মোদী এইবার গণতন্ত্রের থাপ্পড় খেতে চলেছেন। এসব ভারতের মানুষ ভাল চোখে মোটেই নেয়নি। আর মোদী এই গালির জবাবে গালি না দিয়ে এই ব্যাপারটাকে ক্যাশ করেছেন সফলভাবেই। উনি শুধু সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছেন দেখো তোমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অকথ্য ভাষা গালি দেয়া হচ্ছে। সাংবিধানিক পদকে গালি দেয়া হচ্ছে। আর বিনিময়ে আমি তাদের তেমন কিছুই নেতিবাচক বলছি না। আর জনগণের সেন্টিমেন্ট উনি পেয়ে গেছেন সহজেই। যার ফলাফল আমাদের সামনে।ভারতের জনগণ আজ ধর্মনিরপক্ষতা থেকে হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছে একথা সত্য। তবে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে নয়। নিয়েছে নিজের ভাগ্যের উন্নয়নের অন্বেষণে। যদি তারা সেটা বাস্তবায়ন হতে না দেখে তবে হিন্দুত্ববাদকেও ঝেড়ে ফেলতে তাদের সময় লাগবে না।
উল্লেখ্য ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কংগ্রেসের ১০ বছরের শাসনের পর বিজেপি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করায়। আর মোদী এবং বিজেপি গুজরাটের শিল্প উন্নয়নকে উপস্থাপন করে গোটা দেশে মোদী ঝড় বা মোদী ম্যাজিকের আবহাওয়া সৃষ্টি করে এবং সেটা মারাতœকভাবে সফল হয়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৫৪৩ আসনের ভেতর বিজেপির জোট এনডিএ ৩৩৬ টা আসন পেয়ে চমক সৃষ্টি করে যার মধ্যে বিজেপি একাই ম্যাজিক ফিগার অর্থাৎ সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যা ২৭২টি পেরিয়ে ২৮২টি জিতে নেয়। অন্যদিকে কংগ্রেসের এককভাবে অর্জন করে মাত্র ৪৪ টি আসন। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালের নির্বাচনেও বিজেপি তাদের জয়ের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতেই শুধু পারেনি বরং নিজেদের ছাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এনডিএ পেরিয়ে গেছে ৩৫০টির বেশি আসন আর বিজেপি সবাই তাক লাগিয়ে জিতে নিয়েছে ৩০৩ টি লোকসভা আসন। অন্যদিকে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পেলেও সাত্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে গন্য করার মত পর্যাপ্ত নয়। সংসদে তাদের জয়ী প্রতিনিধিদের সংখ্যা মাত্র ৫২।