ভদ্রা নদী দখল করে গড়ে উঠেছে তিন ডজন ইটভাটা, নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র

0
2159

ডুমুরিয়া প্রতিনিধি:
ডুমুরিয়ার ভদ্রা নদীর চর দখল করে গড়ে উঠেছে প্রায় তিন ডজন খানেক ইটভাটা। আইন বহির্ভূতভাবে গড়ে ওঠা এসব ভাটার অধিকাংশগুলোতে রয়েছে নানা ধরণের ত্রæটি বিচ্যুতি। কয়েকটায় নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র। অথচ সেসব ভাটায় চলছে দেদারছে ইট পোড়ানো কার্যক্রম। কয়েকটিতে কয়লার পরিবর্তে কাঠও পোড়ানো হচ্ছে। এদিকে ইট বহনের ফলে গুরুত্বপুর্ন শোলগাতিয়া-দৌলতপুর রাস্তাটাও হুমকীর মধ্যে পড়েছে। লোকালয় ও ফসলী জমির উপরে গড়ে ওঠা এসব ভাটায় ইট পোড়ানোর ফলে এলাকার জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকীর মধ্যে পড়েছে, তেমনি আশপাশের বনাঞ্চলও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর চর দখল করে নদীর দু’পার দিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সময় গড়ে উঠেছে তিন ডজন খানেক ইটভাটা। এর মধ্যে খর্ণিয়া ইউনিয়নের আওতায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে। ভাটা সংলগ্ন রয়েছে কৃষি ভুমি, বন বিভাগের সৃজন করা বন, খর্ণিয়া বাজার, শোলগাতিয়া বাজার, ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর রয়েছে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। ফলে ঘনবসতি এ এলাকায় কোন ভাবেই ইটভাটা স্থাপনের জন্য উপযুক্ত নয়। এনিয়ে স্থানীয় সুশিল সমাজ বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন সংগ্রাম করলেও ইটভাটা মালিকের কালো টাকার জোরে তা ধামাচাপা পড়ে আসছে। অসাধু কিছু ভাটা মালিকরা আস্তে আস্তে ভদ্রা নদীর প্রায় মধ্যপর্যন্ত বেড়ি বাঁধ দিয়ে দখল করে নিয়েছে। এরমধ্যে শাহজাহান জমাদ্দারের ‘জাহান’ ইটভাটাটি নদী দখলে অন্যতম। এ ভাটায় নদীর প্রায় সিংহভাগ গিলে খেয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ ভাটা মালিকরা নদীর জায়গায় বেড়ি বাধ দিয়ে সেখানে পুকুর তৈরি করে অবৈধভাবে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে পলি তুলছে। এর কারণে এক কালের প্রবল খর¯্রােতা ভদ্রা নদী আজ যৌবন হারাতে বসেছে। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষি জমির উর্বর মাটিও আনা হচ্ছে অধিকাংশ ইট ভাটায়।
একটি জরীপে দেখা গেছে, প্রতিদিন দেশে গড়ে ২২০ হেক্টর কৃষি জমি ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্প কারখানা, নগরায়ন, ইটভাটা ইত্যাদী নির্মান কাজে। এরফলে সামগ্রিক পরিবেশের উপর যেমন হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি দ্রæত সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে দেশের কৃষিখাত। এক শ্রেণির মানুষ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কৃষি জমি অকৃষি খাতে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রচলিত আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন সুধিসমাজ। ভাটার ইট বহনের ফলে গুরুত্বপুর্ন খর্ণিয়া-শোলগাতিয়া-দৌলতপুর ও খর্ণিয়া-ভদ্রদিয়া সড়কটি এখন বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে।
মাত্র পৌনে ৪ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৩০/৩২টি ইটভাটা স্থাপনের কারণে ওই অঞ্চলে কৃষি জমিতে ফসলের অনিশ্চিত দেখা দিয়েছে। কয়লা ও ইটভাটার ধুলায় পাশের সবজি ক্ষেত মারা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে বন বিভাগের সৃজনকরা বনায়নের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ইটভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে স্থানীয় কৃষক ও এলাকাবাসী সরাসরি প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কৃষক জানান, ইট ভাটার কারণে তাদের জমিতে সঠিকভাবে ফসল উৎপাদনে ব্যহত হচ্ছে। ক্ষেতের সবজি মারা যাচ্ছে।
সড়কের পাশে গড়ে ওঠা লতিফ জমাদ্দারের জেবি ব্রিকসে দেদারছে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এদিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া রানাই গ্রামে অবৈধভাবে গত ১৮ জানুয়ারী থেকে মেরি ব্রিকস নামে একটি ইটভাটার ইট পোড়ানো কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ভাটায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের অনাপত্তিপত্রও নেই। সম্প্রতি মেরি ব্রিকসের বিরুদ্ধে স্থানীয় এলাকাবাসী খুলনা জেলা প্রশাসক ও খর্ণিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নিকট অভিযোগও করেছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে মেরি ব্রিকসের মালিক মশিউর রহমান বলেন, ‘মেরী ভাটার নামে পূর্বে ট্রেড লাইসেন্স নেয়া আছে। তখন ফিট চিমনী ছিলো। সরকারের নীতিমালানুযায়ী এবং স্থানীয় এলাকাবাসী সহযোগিতায় পরিত্যক্ত ভাটাটি এ বছর জিকজ্যাক করা হয়। কিন্তু স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাল ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছেন না। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের অনাপত্তিপত্র না পাওয়ার কারণে আমি পরিবেশগত ছাড়পত্র এখনো পাইনি। তবে অন্যান্য কাগজপত্র উত্থাপনসহ বিষয়টি খুলনা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে লিখিতভাবে অবগত করেছি।’ এ প্রসঙ্গে খর্ণিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ দিদারুল হোসেন দিদার বলেন, মেরি ব্রিকসের মালিকানা দাবী করে আরো ২ জন ব্যাক্তি আবেদন করেছে। ফলে বিষয়টি তদন্তাধিন রয়েছে। তাছাড়া লোকালয়ে ইট ভাটা স্থাপনের কারণে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ভাটা সংলগ্ন মানুষ শাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এনিয়েও এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, ইট ভাটা থেকে যে দূষিত গ্যাস ও তাপ নির্গত হয় তা আশে পাশের জীবজন্তু, গাছপালা এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ইট ভাটার চিমনি দিয়ে সারাদিন কয়লা জ্বালানোর কারণে যে ধোয়া বের হয় তাতেই আশেপাশের এলাকায় সব গাছের পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। গাছের পাতায় কার্বন পড়ায় পাতা তার খাদ্য উৎপাদনে ব্যহত হয়। আম, লিচু ও নারিকেল গাছের ফুলের পরাগয়নেও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মোঃ হাবিবুল হক খান বলেন, নদীর জায়গা দখল করে ইটভাটা করা কোন বিধান নেই। খর্ণিয়া এলাকার বেশকিছু ইটভাটায় অনেক ত্রæটি বিচ্যুতি আছে। আমাদের অভিযানও শুরু হয়েছে, ইতিমধ্যে মাগুরা ও খুলনার পাইকগাছা এলাকায় অভিযান করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে খর্নিয়া এলাকায় অভিযান হবে। তিনি বলেন, মেরি ব্রীকসে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। ওই ভাটার বিরুদ্ধে স্থানীয় চেয়ারম্যানেরও অভিযোগ রয়েছে।