ব্র্যান্ডের দুধেও ভেজাল!

0
385

থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে অবশেষে। হাইকোর্টের নির্দেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দেশের নামী-দামী কোম্পানির প্রায় সবক’টি ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত তরল দুধে ভেজালের কারণে দায়ের করেছে মামলা। এর আগে এসব কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সিসার উপস্থিতির কথা জানিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। এর বাইরেও বিভিন্ন কোম্পানিসহ বাজারজাত ও সরবরাহকৃত তরল দুধের প্রায় সব নমুনা পরীক্ষা করে পাওয়া যায় জনস্বাস্থ্যের জন্য অনুপযোগী মারাত্মক ক্ষতিকর পদার্থ। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাডমিয়াম, মেলামাইন, ডিটারজেন্ট, ব্যাকটেরিয়া, ই-কোলাইসহ বিভিন্ন জীবাণু, এ্যান্টিবায়োটিক, সর্বোপরি দূষিত পানি। সবশেষে সিসা। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সর্বপ্রথম এই গবেষণাটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি বিভাগের একদল গবেষক। তখন এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে সরকারী সংস্থা বিএসটিআই, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা যাচ্ছেতাই ভাষায় বিষোদগার করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি-ধমকি দেন। এমনকি তারা অধ্যাপক ফারুকের গবেষণার এক্তিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, যা ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও রীতিমতো অশোভন। এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের নির্দেশে এসব কোম্পানির প্যাকেটজাত দুধের নমুনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় ব্যাপকভাবে। এগুলো হলোÑ বাংলাদেশ এগ্রিক্যালচারাল ইনস্টিটিউট, বিসিএসআইআর, প্লাজমা প্লাস, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, সর্বোপরি আইসিডিডিআরবি। তারা পাস্তুরিত দুধ, খোলা দুধ ও গোখাদ্য পরীক্ষা করে প্রায় সবক’টিতেই নানা মাত্রা ও পরিমাণের ভেজাল পেয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে এসব কোম্পানি ব্র্যান্ডের দুধের নামে ভেজাল ও দূষিত দুধ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সমূহ ক্ষতি করে একচেটিয়া মুনাফা লুটছে। এটা দেশের জনসাধারণের সঙ্গে ¯্রফে প্রতারণা। ফলে দুধ নিয়ে সমূহ বিপদ ও বিপাকে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষ। দেশে প্যাকেটে বাজারজাতকৃত পাস্তুরিত তরল দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয়- ইতোপূর্বে ঢাকায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। দুগ্ধ খামার থেকে শুরু করে বিক্রির দোকান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দুধে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদ-ে গ্রহণযোগ্য নয়। এই দুধ উচ্চতাপে ফুটিয়ে না খেলে তা বিপজ্জনক হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর পাশাপাশি দুধের পুষ্টিমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদুপরি পেটের পীড়া, বদহজম, আমাশয়সহ নানা রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ হতে পারে। চাহিদা পূরণে বিপুল পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে গুঁড়াদুধ ও পশুখাদ্য আমদানি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার। দেশে পশুখাদ্যের দামও অত্যধিক ও ভেজাল মিশ্রিত।
জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের মতে গত কয়েক বছরে দুধের উৎপাদন বাড়লেও তা চাহিদার তুলনায় তিন ভাগের দুই ভাগ। দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা এবার গুঁড়া দুধের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ করাসহ ২০ বছরের ট্যাক্স হলিডে এবং স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। দেশীয় দুগ্ধশিল্পকে বাঁচানো তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সরকার তথা প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আরও করণীয় রয়েছে। অতীতের মতো চীন থেকে ক্ষতিকর মেলামাইন মিশ্রিত অথবা পোল্যান্ড থেকে চেরনোবিলের পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় মিশ্রিত দুধ আমদানি বন্ধ করতে হবে। সর্বাত্মক জোর দিতে হবে দেশীয় গবাদি খামার শিল্প প্রতিষ্ঠায়।