বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ওঠা-নামা থেমে নেই

0
279

খুলনাটাইমস অর্থনীতি: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ওঠা-নামা চলছেই। মার্চের প্রথম তিন দিনে এই রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের উচ্চতায় উঠলেও গত ৪ মার্চ ফের নেমে যায় ৩২ বিলিয়নে। আর রোববার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এর পরিমাণ খানিকটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২১৫ কোটি (৩২.১৫ বিলিয়ন) ডলারে। সর্বশেষ গত ৩ মার্চ রিজার্ভের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৩ হাজার ৩০৯ কোটি (৩৩.০৯ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
সাধারণত রফতানি ও প্রবাসী আয় বাড়লে রিজার্ভ বাড়ে। তবে বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপসহ বিবিধ কারণে গত কয়েক মাস ধরে রফতানিতে শোচনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দীর্ঘ আড়াই বছর পর গত ১ মার্চ রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রফতানি কমলেও আমদানি ব্যয় কমে আসার পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়নে উঠতে সক্ষম হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী সাইদুর রহমান বলেন, প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়া ও আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ার কারণে রিজার্ভ ১ মার্চ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। তবে ৩ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তিনি জানান, এই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে ৮ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আমদানি পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত দুই বছর ধরে অব্যাহতভাবে কমছে আমদানি ব্যয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানি বেড়েছিল ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। অথচ গত সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানি ব্যয় কমেছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ
গত দুই বছর ধরে আমদানিতে বিপর্যয় নেমে এলেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অব্যাহতভাবে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের আট মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় কমে আসা। তবে আগামীতে রিজার্ভ চাপে পড়তে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি। তিনি বলেন, এতদিন একমাত্র রেমিট্যান্স বাড়লেও এখন সেটাও কমে আসছে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে এখন বড় সংকট চলছে। আমদানি ভয়াবহভাবে কমে এসেছে। রফতানিও কমে গেছে। অচিরেই অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের মাস জানুয়ারিতে তারা পাঠিয়েছিলেন ১৬৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ১৮ কোটি ডলার কমে গেছে।
৩৩ বিলিয়নের প্রথম রেকর্ড
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাকি রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। তবে ১৬ বছর পর ২০১৭ সালে সেই রিজার্ভ গিয়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ঠেকে।
প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ রেকর্ড তথা ৩৩ বিলিয়ন ডলার উচ্চতায় উঠে ২০১৭ সালের ২১ জুন। সেইদিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩০১ কোটি ডলার। এরপর ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর, ২ নভেম্বর ও ২৮ ডিসেম্বর ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ফিরলেও এখন পর্যন্ত ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ২৯৯ কোটি ডলার। এর দেড় মাস পর ১৮ মে এটি বেড়ে হয় ২ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। এর দেড় মাস পর ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০২ কোটি ডলার। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৬ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৩ কোটি ডলার। একইভাবে ২০১৭ সালের ৩১ মে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ২২৪ কোটি ডলার। ওই বছরের ২১ জুন রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০১ কোটি ডলার।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ দিকে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভে ছিল এক বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড থেকে রেকর্ড উচ্চতায় ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখতবলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতায় ওঠার ক্ষেত্রে বড় অবদান রয়েছে প্রবাসীদের। এ ছাড়া রফতানি আয়েরও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। রফতানি আয় ও প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠায় বলেই রিজার্ভ একাধিকবার ৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
প্রবাসী আয়ের শীর্ষ ৬ দেশ
প্রবাসী আয়ের সিংহভাগ আসে ৬টি দেশ থেকে। দেশগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন থেকেও প্রবাসীরা তাদের কষ্টের আয়ের টাকা বাংলাদেশে পাঠিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে সৌদি আরব থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেখান থেকে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২৫৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৩১১ কোটি ৪ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসেই দেশটি থেকে এসেছে ২৫৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২৪২ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই দেশ থেকে এসেছে ২৫৪ কোটি ৪ লাখ ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে এসেছে ১৭৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৯৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছে ১৮৪ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে কুয়েতের প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১১৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছে ১৪৬ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১১০ কোটি ৭২ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছে ১১৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১১০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছে ১১৭ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
রফতানি পরিস্থিতি
অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রফতানি আয় কমেছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম আট মাসে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ২ হাজার ৬৪১ কোটি ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়। চলতি অর্থবছরের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। তবে প্রথম আট মাস শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি পিছিয়ে আছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ।