বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ম-নীতি মানছে না : জীবন-মৃত্যু নিয়ে বাণিজ্য!

0
1803

কামরুল হোসেন মনি:
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে জীবন-মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করছেন এক শ্রেণির অসাধু ক্লিনিক ব্যবসায়ী। খুলনা মহানগরীতে যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই ব্যবসা চলছে দেদারছে। এক শ্রেণির অসাধু ক্লিনিক মালিক, ভুয়া ডাক্তার ও দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সহজ-সরল রোগী ও তার পরিবাররা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। মাঝে মধ্যে র‌্যাবের অভিযান ও মোবাইল কোর্টের জরিমানাও গুণতে হচ্ছে ওই সব প্রতিষ্ঠানকে। তবুও থেমে নেই তারা। খুলনা মহানগরীতে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মিলে লাইসেন্স প্রাপ্ত ১৬০টি। এর বাইরে লাইসেন্সবিহীন অসংখ্য ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
নগরীর সিভিল সার্জন অফিসের পেছনে গড়ে ওঠা ডাঃ আমান উল্লাহ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠানটি জন্মলগ্ন থেকেই লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। নেই মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সও। এদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে গেলেই স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ ও বিভিন্ন তদবিরের কারণে অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন।
খুলনা বিভাগের (স্বাস্থ্য) পরিচালক ডাঃ মোঃ রওশন আনোয়ার বলেন, বর্তমানে কেউ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করতে গেলে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র, নারকোটিকস এর লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর বাইরে আরও কিছু শর্ত আছে, সেগুলো পূরণ করেই আবেদন করতে হবে। আবেদন করার পর ওই প্রতিষ্ঠানে তদন্ত কমিটি যাবে। যদি হাসপাতাল করার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের সব শর্ত পূরণ থাকে, তবেই তাকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়। নগরীতে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক করার অভিযোগ পেলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।
খুলনা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র মতে, খুলনা মহানগরীতে বর্তমানে লাইসেন্স প্রাপ্ত ১৬০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ক্লিনিকের সংখ্যা রয়েছে ৭৬টি। বাকীগুলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এছাড়া নতুন করে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মিলে মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সব শর্তগুলো পূরণ থাকলে লাইসেন্স এর জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়। তবে সিভিল সার্জন অফিসের পেছনে গড়ে ওঠা ডাঃ আমান উল্লাহ ক্লিনিক ও মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগে লাইসেন্স এর জন্য আবেদন জমা পড়েনি। এতদিন ধরে লাইসন্সেবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালিয়ে আসায় জনমনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ডাঃ আমান উল্লাহ ক্লিনিকের দায়িত্বরত প্যাথলজি ইনচার্জ স্বপন কুমার বলেন, ডাক্তার ঢাকায় অবস্থান করছেন। এই কারণে কোন রোগী ভর্তি নেই। প্যাথলজি খোলা আছে, দুই-একটা রোগী আসলে সামান্য টেস্ট করাই। লাইসেন্স’র বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো লাইসেন্স পাইনি, একবার আবেদন করা হয়েছিল- ওই সময় দেয়নি। আবার আবেদন করা হয়েছে। ২৫-৩০ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করেন তিনি। লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক চালানোর বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। শুধু ওই ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারই না। এ রকম নগরীতে অলিগলিতে অসংখ্য গড়ে উঠেছে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কেউ ডাক্তার না, তারপরেও ডাক্তারের সাইনবোর্ড লাগিয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে জীবন-মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করছেন।
২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর রাতে নগরীর মহানগরীর শিপইয়ার্ড মেইন রোডের বেসরকারি আরাফাত হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান ও নিজাম উদ্দিন নয়ন নামে দুই ভুয়া চিকিৎসককে আটক করেছিল র‌্যাব-৬। তারা দু’জন আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা ও ৬ মাসের কারাদ- দেন। ওই সময় খুলনা জেলাপ্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিবেদিতা চাকমা বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান ও নিজামউদ্দিন নয়ন নিজেদের ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ডাক্তার নন। তারা ভুয়া পরিচয় দিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করছিলেন। এছাড়া হাসপাতালের লাইসেন্সটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে খুলনায় র‌্যাব-৬ এর সদস্যরা নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে ৭ জন ভুয়া চিকিৎসককে আটক করেছিলেন। অভিযানে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। ওই সময় মীম নার্সিং হোমের ভুয়া চিকিৎসক ফেরদাউস রহমানকে ২ বছরের কারাদ- ও ১ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৩ মাসের কারাদ- দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। খুলনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুয়া চিকিৎসক পঞ্চানন মহলী ও সেবা ক্লিনিকের ভুয়া চিকিৎসক অনুপ মিত্রকে ২ বছর করে কারাদ- ও ২ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ৩ মাস করে কারাদ-, শাহাবুদ্দিন মেমোরিয়াল ডেন্টাল ক্লিনিকের ভুয়া ডাক্তার গাউসুল আজম, এএন ডেন্টাল কেয়ারের ভুয়া ডাক্তার সৌমেন ও রংধুন ক্লিনিকের ভুয়া ডাক্তার ইব্রাহিম বাহাদুরকে ৯ মাস করে কারাদ- ও ১ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ৩ মাস করে কারাদ- এবং প্রাইভেট প্রাকটিস করা ভুয়া চিকিৎসক ডা. কান্তিলালকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। জানা গেছে, খুলনা মহানগরীসজ প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে রয়েছে ডায়াগনস্টিক  সেন্টারসহ নানা ক্লিনিক। এর একটি বড় অংশের নেই সরকারি অনুমোদন।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অনুমোদন দেয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মহলের তদবির লেগে থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কিছুই করার থাকে না। প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক বা চিকিৎসক নেতাই বেশি তদবির করেন। আর এসব  বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বেশিরভাগেরই মালিক নামে বেনামে বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক। এছাড়া হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা গেলে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে সাময়িকভাবে ক্লিনিকের কার্যক্রম গুটিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই হাসপাতাল বা ক্লিনিক মালিকরা এসবের তোয়াক্কা করেন না। বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা শুরু করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়নও করা হয় না। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন তো আরো দূরের কথা। ##