বীরযোদ্ধা আব্দুল মালেক এখন আলোকচিত্রী

0
455

এম জে ফরাজী, খুলনা:
ফটোসাংবাদিক আব্দুল মালেক। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। খুলনার মানুষের কাছে মালেক ভাই হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি। একাত্তরে অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুর দিকে বুলেট ছুড়ে দেয়া মুক্তিযোদ্ধা মালেক এখন অস্ত্রের পরিবর্তে ক্যামেরা তাক করেন বিষয়বস্তুর দিকে।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিন মাথায় ক্যাপ ও হাতে ক্যামেরা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন জীবন সংগ্রামে। তার তোলা ছবি ছাপা হয় জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায়। জীবন সংগ্রামে সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও ভুলতে পারেন না মুক্তিযদ্ধের সেই সময়কার স্মৃতিগুলোকে। যা তাকে একাধারে আনন্দ আর বেদনার মিশ্র অনুভূতি দেয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন করার আগে স্বাধীন দেশের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা এখনও বাস্তবায়িত হয় বলে আক্ষেপ করে বেড়ান তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সারাদেশে কার্ফিউ জারি করা হয়। এই কার্ফিউর সময় আরও বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে পরদিন ২৭ মার্চ সকালে একটি সাদা গাড়িতে করে দুই পাক সেনা প্রবেশ করে বর্তমান খুলনা মহানগরীর খালিশপুর থানা এলাকার বৈকালী এলাকার জয়নালের হোটেলের সামনে। তখন বয়সে তরুণ তিনি। এলাকার সামাদ ওরফে জাদুকর সামাদের নেতৃত্বে ইপিআরের সঙ্গে জোট করে দুই পাক সেনার ওপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করেন তারা। ঘটনাস্থলেই মারা যায় ওরা দুজন। এভাবেই জড়িয়ে পড়েন দেশ স্বাধীন করার সংগ্রামে। ২৮ মার্চ খুলনা বিভাগীয় গণ-গ্রন্থাগারের সামনে কালভার্ট ভেঙ্গে গাছের গুড়ি দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেন।
মালেক বলেন, ইপিআর এর সঙ্গে নয়, নিজেরাই মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন। এমন আশা বুকে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য সে সময় পাড়ি জমান ভারতে। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন খুলনায়। ভারতে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরে। তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল ও সহকারী ক্যাম্প কমান্ডারের নির্দেশে ভৈরব নদ পেরিয়ে চলে যান দিঘলিয়া উপজেলায়। সেখানে পথের বাজার এলাকায় রাজাকারদের সঙ্গে প্রথম সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত ও আহত হয়।
যুদ্ধের শেষের দিকের কথা স্মরণ করে মালেক বলেন, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও খুলনা তখনও ছিল পাক সেনাদের দখলে। ১৭ ডিসেম্বর খুলনা স্বাধীন হয়। এইদিন দুপুরের দিকে খুলনা জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় মুক্তিযোদ্ধারা।
তিনি বলেন, আমরা তখন নগরীর শের-ই-বাংলা রোডের স্টার সিনেমা হলের পশ্চিমপাশে বিহারী কলোনিতে অবস্থান করছি। পাশের বাড়িতে এক রিকশাচালক তার পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে বসবাস করতেন। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে তখন। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ বিমান আকাশে টহল দিচ্ছিল। এমন সময় ওই এলাকার ঝুড়িভিটা বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে থেকে রাজাকাররা বিমান লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা বর্ষণ করে। তখন এলাকার নিরীহ মানুষদের নিরাপদে সরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। এলাকাবাসী সরে যাবার পর মিত্র বাহিনীর বিমান থেকে রাজাকারদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। সেই সময় ওই পরিবারের সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। সবাই মারা যান। যুদ্ধের পর কেউ তাদের খোঁজ নিতে আসেনি। যা মুক্তিযোদ্ধা মালেককে আজও ব্যথিত করে তোলে। এই যুদ্ধের কোনো এক সময় তার ডান হাতটি শত্র“র আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই বাম হাতেই করতে হয় সব কাজ।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে অনেকের মতো আব্দুল মালেকও হয়ে পড়েন কর্মহীন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে এক সময় শুরু করেন কাঁচামালের ব্যবসা। কিন্তু সেই ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে শুরু করেন ঠিকাদারী। কিন্তু হাতের সমস্যার কারণে এক সময় তাও ছাড়তে হয় তাকে। এই অবস্থার মধ্যেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এরপর এক সময় কাঁধে তুলে নেন ক্যামেরা। সাংবাদিকতা জগতে সেই শুরু। বর্তমানে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে চলছে তার জীবন। এক সময় অনেক বেতনের চাকরি করলেও এখন আর পারিশ্রমিক মেলে না তার। বর্তমানে একটি অনলাইন এবং একটি পত্রিকায় কর্মরত রয়েছেন তিনি। নামে মাত্র সম্মানী পান প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। আর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে যা পান তা নিয়েই কোনো রকমে চলে যায় তার।
আক্ষেপ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, একটি সুন্দর দেশ দেখার তীব্র আশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই আশা আজও পূরণ হয়নি। যেদিকে তাকাই সেই দিকেই হাহাকার। অনিয়ম, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে সব জায়গা। এর থেকে দেশ যে কবে পরিত্রাণ পাবে? তবে তিনি মনে করেন, যে আশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, তা একদিন পূরণ হবেই হবে।