বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মারিনো রিগন আর নেই

0
902

খুলনা টাইমস প্রতিবেদক: ফাদার মারিনো রিগনবাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মারিনো রিগন আর নেই। ২০ অক্টোবর শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ইতালির ভিচেঞ্চায় মারা গেছেন এ মুক্তিযোদ্ধা। দেশের প্রবাসী এ বন্ধু ছিলেন একাধারে দার্শনিক লেখক, অনুবাদক, মানবসেবক ও সমাজসেবক। তবে বাংলাদেশের জন্য তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি ছিলেন বাঙালি, বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের পরমাত্মীয়।
ভাগ্নি মারতা আলেসান্দ্রো জানিনের বরাত দিয়ে প্যারিস প্রবাসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবীশঙ্কর মৈত্রী ফাদার মারিনো রিগনের মৃত্যুর খবর জানান।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে রবীশঙ্কর মৈত্রী বলেন, দার্শনিক, লেখক, অনুবাদক ও মানবসেবক ফাদার মারিনো রিগন দেহত্যাগ করেছেন। এইমাত্র তিনি মায়াত্যাগ করে চলে গেছেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইতালির ভিচেঞ্চায় বিশেষ যত্নে ছিলেন। তার আর বাংলাদেশে ফেরা হল না। ফাদার রিগনের ভাগ্নি মারতা জানিন ইতালির ভিল্লভেরলা থেকে শোক সংবাদটি জানালেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি জসীম উদদীনের সঙ্গে ফাদার মারিনো রিগনইতালির ভিচেঞ্চা প্রদেশে ভিল্লাভেরলা গ্রামে ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে তার প্রথম আগমন। কর্মসূত্রে দেশের নানা অঞ্চল ঘুরে অবশেষে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন সুন্দরবন কাছে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে।
ফাদার মারিনো রিগন বাংলাভাষা শিখতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রেমে পড়েন গভীরভাবে। শরৎচন্দ্রের লেখা পড়েই বাংলাসাহিত্যে তার প্রথম প্রবেশ; তারপর রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। পড়তে থাকেন রবীন্দ্র রচনাবলি। রবীন্দ্র-জীবনদর্শনে তিনি আপ্লুত-প্রাণিত-মুগ্ধ। লোকায়ত বাংলার চারণ দার্শনিক লালনের প্রতি তিনি গভীর কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। লালন-গান তাকে সাধনার নতুন পথ দেখায়। ইতালিয়ান ভাষায় তিনি অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ চল্লিশ কাব্য, জসীম উদদীনের নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা, লালনের তিনশো পঞ্চাশটি গান ছাড়াও বাংলাদেশের অসংখ্য কবিতা। তিনি ইতালীয় রূপকথা পিনোকিও অনুবাদ করেছেন বাংলাভাষায়। তিনি কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের কবিতায়ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

ফাদার মারিনো রিগন মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধপীড়িত সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন দেশপ্রেমিক বাঙালির মতো। মানবসেবা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়। এ ছাড়াও দেশে-বিদেশে বহুসংখ্যক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন; মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইতালির ভিচেঞ্চায় বিশেষ যত্নে ছিলেন। কিন্তু তিরানব্বই বছর বয়সে জীবনের মায়া ত্যাগ করে অবশেষে চলে গেলেন এ মহান ব্যক্তিত্ব।

ফাদার মারিনো রিগন তার স্বজনদের শর্ত দিয়েছিলেন, ইতালিতে যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। ইতালির স্বজনেরা মেনে নেন তার শর্ত। এরপর তিনি উন্নত চিকিৎসায় ইতালি যান। সেখানেও অস্ত্রোপচারের আগে স্বজনদের কাছে তার শেষ মিনতি ছিল, আমার মৃত্যু হলে লাশটি বাংলাদেশে পাঠাবে।