বঙ্গবন্ধুর জন্ম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি

0
670

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম:

১৭ মার্চ, ১৯২০। ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। আজ সেই মহান পুরুষের জন্মদিন, যাঁর নামের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালীর আত্মপরিচয়। তিনি সেই মহান পুরুষ, যাঁকে নিয়ে বাঙালীর অহঙ্কার কোনদিন ফুরোবে না। এমনই বিশাল ব্যক্তিত্ব তিনি, মৃত্যুর চার দশক পরও তাঁকে আবিষ্কার করতে হয় নতুন করে। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালী জাতিকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অসম্ভবের পথ। আমাদের দিয়ে গেছেন দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজ ইতিহাসের অমর মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।

বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়রা খাতুন আদর করে ডাকতেন খোকা। পিতা-মাতার চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে খোকা ছিলেন তৃতীয়। খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালীর মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা। এক রাজনৈতিক সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে। খুব ছোট থাকতেই বঙ্গবন্ধুর মা একদিন দেখেন,“তাঁর খোকা চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে। পরনে পায়জামা, পাঞ্জাবি নেই, কি ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে পরিহিত তার শতচ্ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছে।” কোনোদিন দেখলেন, কোনো ছেলে টাকার অভাবে ছাতা কিনতে পারে না, রোদ-বৃষ্টিতে ভারি কষ্ট পায়, অমনি তাঁর ছাতাটা দিয়ে দিতেন। কিংবা টাকার অভাবে কোনো ছেলে বইপত্র কিনতে পারছে না, দিয়ে দিলেন তাঁর নিজের বইপত্র। বঙ্গবন্ধু আজ বাহ্যিক শরীরে আমাদের সামনে নেই তবুও তাঁর দেখানো আদর্শসমূহ আমাদের সামনে সর্বদা বিরাজমান।

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিপ্লবের জীবন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজরা যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে এবং সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। সেই অল্প বয়সেই বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সেবায় দিন রাত এক করে কাজ করেছেন। মানুষের সেবার জন্য বিশ্রাম নেয়া ভুলে গিয়েছিলেন। অনেক রাত তিনি লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। একটি জাতির আত্মানুসন্ধান তিনি হয়ত যুবক বয়স থেকেই শুরু করেছিলেন।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদানকে আমরা অনেকেই এড়িয়ে যাই কিংবা জানার চেষ্টা করিনা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ যখন জিন্নাহ ঢাকার ঘোড় দৌড় মাঠে ঘোষনা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন তরুন শেখ মুজিবসহ অনেক ছাত্র চিৎকার করে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘মানি না’। এরপর আমৃত্যু জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা আর বলেননি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী বিকালে পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন জানাল উর্দুই হবে এক মাত্র রাষ্ট্রভাষা। সেই সময় বঙ্গবন্ধু কারাবন্দি হিসেবে হাসপাতালে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাত একটার পরে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ আরও অনেকে। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের হুকুম দিয়েছিলেন এবং পরের রাতে তাদের আবার আসতে বললেন। সেখানেই ঠিক হয়েছিল ২১ ফেeªæয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। আজ আমরা একটি বারও বলিনা ২১ ফেeªæয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস কে (কাহাদের বৈঠকে) নির্ধারণ করেছিলেন?

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায় হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালীর এই বিজয়কে মেনে নিতে না পেরে ৯২-ক ধারা জারি করে সরকার অপসারণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেeªæয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের একটি কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ঐ ৬ দফা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। শেখ মুজিবের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে জেনারেল আইয়ুব খান একটার পর একটা মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। সেই সময় রাজনীতির প্রধান আলোচিত বিষয় হয় ৬ দফা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গীদের নামে আইয়ুব খান তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় গোটা বাঙালী জাতি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে আনে। বাঙালী জাতি তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। এর পর যে ইতিহাস রচিত হলো, সে ইতিহাস সবারই জানা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর ভবিষ্যত নির্ধারণ হয়ে যায়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বীর বাঙালী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে নেয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিনটি সেদেশে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিও আমাদের দেশ শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৭৫ পরবর্তীতে ইতিহাস বিকৃত করার অনেক অপচেষ্টা করা হয়েছে। খুব আনন্দের সাথে আজ বলতে পারি, ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষনা করেন। ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে সাথে নিয়ে ক্ষমাতায় এসেই তৎকালীন বিএনপি সরকার জাতীয় শিশু দিবস পালনের রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে দেয়। ধিক্ তৎকালীন বিএনপি সরকারকে তাদের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য। জননেত্রী শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আবার পালিত হচ্ছে জাতীয় শিশু দিবস। সাবাস জননেত্রী শেখ হাসিনা। আপনার জন্য কিছুটা হলেও আমাদের পাপ মোচন হয়েছে।

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চিত্রায়িত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কারণেই। বিশ্বসভায় বাঙালী জাতির সগর্ব উপস্থিতিই স্মরণ করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুকে। এ অবিভাজ্য অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি নেই। সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আর এই দেশের ভুখন্ড থেকে শুরু করে তাপক্লিষ্ট, কুলি-কামিন, মজুর, কৃষাণ-কৃষাণী, জেলে-বাওয়ালী, বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষেরা ছিল তার রাজনীতির অবলম্বন। এদের জন্যই তিনি লড়েছেন। শৈশব থেকে আমৃত্যু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করেছেন তিনি। জাতি-বর্ণ, বিভেদ-বৈষম্য তাঁর কাছে ছিল না। বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের জীবনকে দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে কোনো পুরষ্কার চাননি। আমরা অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে দলীয় বা রাজনৈতিক আওতায় ফেলে তাঁর আলোচনা বা সমালোচনা করে ফেলি, যা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি কারো একার নয়, তিনি সকলের। তাঁর জন্মই হয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য। আজ এই দিনে শুভ জন্মদিন জানাই আমাদের সেই অমর মহানায়ককে।

লেখকঃ সভাপতি, সদর থানা আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর, খুলনা।