বকুল ট্রি খ্যাত হতদরিদ্র সিদ্দিক গাজীর নতুন স্বপ্ন তাল গাছ

0
649

মনুষ্যসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বজ্রপাতে মানুষকে বাঁচাতে সিদ্দিকের নতুন স্বপ্ন

শেখ নাদীর শাহ্,কপিলমুনি::


একজন সিদ্দিক গাজী। বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। এলাকার অনেকে সিদ্দিক পাগল বলে জানে। কেউ চেনে বকুল সিদ্দিক নামে। ভাল বাসেন গাছ লাগাতে। প্রথমত উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরে এলাকার সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বকুল গাছ লাগিয়ে আত্ন তৃপ্তি খুঁজতেন। আর এখন তালের চারা রোপন করছেন। শুনেছেন ঘণ ঘণ বজ্রপাতে জীবনহাণি ঠেঁকাতে পারে তাল গাছ। তাই মানব কল্যাণে শুরু করেছেন সম্ভাব্য সব জায়গায় তালের চারা রোপন। এজন্য দেশ সেরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে পুরষ্কৃতও হয়েছেন তিনি।

সিদ্দিক মোড়লের বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির শ্যামনগর গ্রামে। হতদরিদ্র সিদ্দিকের স্থাবর অস্থাবর বলতে রয়েছে পলিথিনের ছাউনির একটি কুঁড়ে ঘর। সেখানেই স্ত্রী,এক ছেলে জাহিদুল ইসলাম (১১) ও এক মেয়ে খাদিজা খাতুন(৯) কে নিয়ে তার বসবাস। সম্প্রতি অবশ্য সরকারের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পে একটি টিন সেডের ঘর জুঠেছে তার।

দারিদ্রতা পিছু না ছাড়লেও সুখের অভাব নেই তার ঘরে। মানুষের স্বার্থে পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বকুল গাছ লাগিয়েই সুখ খোঁজেন তিনি। তাই সুখী তিনি। জীবনের ৩৪ বছরেরও বেশী সময় ধরে সংসার ও নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বকুল গাছ লাগিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজ উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বকুল গাছ লাগানোর পাশাপাশি সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার বিভিন্ন শিক্ষা,সরকারী-বেসরকারি অফিস,ক্লাব ঘর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার পাশে অন্তত ১২ হাজারেরও বেশী বকুল গাছ লাগিয়েছেন,হত দরিদ্র সিদ্দিক গাজী। তবে পরিবেশ বিপর্যয়ে ঘণ ঘণ বজ্রপাত নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে তাকে।

মানুষের কি হবে? তারা তো প্রায়ই বজ্রপাতে মরছে। তবে শুনেছেন,তালা গাছ বহুলাংশে বজ্রপাত প্রতিরোধ করে। তাই এবার নতুন নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। জীবিকার মাধ্যম বিভিন্ন স্বাস্থ্যকরী বুনো শাঁক পাতা সংগ্রহ করে বাজারে বাজারে,কখনো বা গ্রামে ফেরী করে বিক্রির পাশাপাশি মৌসুমে সংগ্রহ করছেন তাল বীজ (তালের আটি)। আর তা রোপন করছেন, সম্ভাব্য সব জায়গায়।

হত দরিদ্র সাদা মনের পরোপকারী এ মানুষটি গাড়িতে চড়তে ভয় পান। ব্যয় সংকোচন,শারীরিকসহ নানা প্রশান্তিতে সেই প্রথম থেকে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান তিনি। তাই পায়ে হেঁটেই যতদূর পৌছানো সম্ভব ততদূর বৃক্ষ রোপন বিস্তৃতি। শুধু এখানেই শেষ নয়,গাছ লাগানোর পাশাপাশি তা যথা সম্ভব পরিচর্যাও করেন। এলাকা বা পাশাপাশি কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের বকুল গাছের চারা উপহার দিয়েও আত্নতৃপ্তি পান তিনি। সেকারণে এলাকায় বকুল ট্রি নামেও সমধিক পরিচিত তিনি।

জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও খানিকটা সংসার বিবাগী সিদ্দিক স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে শুধু জীবিকার অন্বেষণে পথের ধারে,খাল-বিল ও ঝিঁলে জন্ম নেওয়া হেলেঞ্চা,বিরমি,কলমিসহ নানা জাতের বনজ শাক-সব্জি কুড়িয়ে বেড়ান। এরপর তা ফেরী করে উচ্চস্বরে তার উপকারিতার কথা জানান দিয়ে বিক্রি করেই চলে তার সংসার।

সিদ্দিকের ছোট ভাই লুৎফর রহমান বলেন, সংসারে অভাব থাকলেও তার শান্তির সংকট নেই। জীবনে কখনো কোনো লোভ স্পর্শ করতে পারেনি তার ভাইকে। তার মত করে চলার পথে বিভিন্ন সময় পরিবার থেকে বহু বাঁধা বিপত্তি আসলেও তিনি দমে যাননি। মানব কল্যাণে পরিবেশ সুরক্ষায় এখন পর্যন্ত রোপন করেছেন, প্রায় ১২ হাজার বকুল গাছ।

তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতির গাছের ভীঁড়ে তিনি কেবল বকুল গাছকে কেন বেঁছে নিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বরাবরের মত সিদ্দিক গাজীর সোজা-সাফটা জবাব, বকুলগাছের ফুল ও ফল ছেলেমেয়েদের কাছে খুব প্রিয়। পাখিও এর ফল খায়। আর বকুল ফুলের সুগন্ধ যেকোনো মানুষের মনকে ভালো করে দেয়। বিশেষ করে আজকের কোমলমতিরাই আগামীর ভবিষ্যত,সেকারণে বকুলের মিষ্টি সুবাস তাদের মনকেও প্রফুল্ল রাখবে। তাছাড়া বকুলের চারা উৎপাদন খানিকটা হলেও সহজলভ্য।

বকুল মাঝারি আকৃতির পাতাবহুল গাছ হলেও এটি মূলত ফুলের জন্য সর্বজন প্রিয়। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এই গাছ দেখা যায়। ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াতেও বকুলের সরব উপস্থিতি দৃশ্যমান। ছোট তারকা আকৃতির মাঝঘানে ছিদ্র অবয়বে বকুল ফুল রাতে ফুঁটে এলাকাময় তার মিষ্টি অস্তিত্ব জানান দেয়। এরপর রাতের শেষে দিনভর টুপটুপ করে গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ে। শুকনো অবস্থাতেও বকুলের সুবাস জিইয়ে থাকে অনেক দিন। বিভিন্ন অঞ্চলে বকুলের মালা গেঁথে পথ শিশুরা তাদের ছোট ছোট স্বপ্ন বুনে। ডিম্বাকৃতির লাল পাকা ফল কষ-মিষ্ট। পাখপাখালির পাশাপাশি কিশোর-তরুণেরা এ ফল মজা করে খায়। কখনোই গাছের সব পাতা ঝরে পড়ে না বলে এটি অন্যতম ছায়াবৃক্ষ। এর কাঠ অনেক শক্ত, তবে মসৃণ।

সিদ্দিক গাজী বলেন, ‘শুধু মনের ইচ্ছা থেকেই বকুলগাছ লাগানো শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথমে চারটি গাছ লাগানোর পর মনের জোর বেড়ে যায়। এরপর যত দূর হেঁটে যাওয়া যায় তত দূর পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বকুলগাছ লাগিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

১৯৮৫ সাল। চারা মৌসুমের যেকোন দিন কষ্টাজিত ৪০ টাকায় স্থানীয় বাজার থেকে চারটি বকুল গাছের চারা কেনেন তিনি। এরপর পায়ে হেঁটে চারাগুলো নিয়ে চলে যান সেখান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে কপিলমুনি কলেজে। সেখানে একটি বকুলের চারা রোপন করেন। তারপর কপিলমুনি আলিয়া মাদ্রাসায় একটি চারা রোপণের পর ফের হাাঁটা শুরু করেন চলে যান প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরার তালা সরকারি কলেজে। কলেজের অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে লাগান আরেকটি চারা। এরপর যান প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরের একই জেলার পাটকেলঘাটা উপজেলার হারুনার রশিদ কলেজে। স্বপ্নের শেষ বাকি চারাটি রোপণ করেন সেখানে।

এই চারটি গাছ লাগানোর পর ১৯৯০ সালে স্থানীয় একটি নার্সারি থেকে আরও ২০টি গাছ কিনে তা যশোরের কেশবপুর কলেজ, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রোপণ করেন সিদ্দিক গাজী। এভাবেই ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ক্লাবের জায়গায় একের পর এক বকুলের সুবাস ছড়িয়ে চলেছেন তিনি।

খুলনা জেলা স্টেডিয়াম, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ জেলার বিভিন্ন সড়কে রয়েছে সিদ্দিক মোড়লের লাগানো বকুলগাছ। খুলনা জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি সরদার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৫ সালের দিকে তার সাথে যোগাযোগ করেন সিদ্দিক। তারপর কয়েক শ’ বকুল গাছের চারা নিয়ে আসেন। সেগুলো জেলা স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন ক্লাবের সামনে রোপণ করেন। আর কিছু চারা লাগান জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বাসভবনে।’ তিনি বলেন, সিদ্দিক সরল সাদা মনের একজন নির্লোভী মানুষ। বকুলগাছ লাগানোর জন্য কেউ তাকে টাকা দিতে গেলে তিনি তা কখনো গ্রহন করেননি। বুনো শাক-সব্জির স্বাস্থ্যের ফেরি করে অন্যের সুস্থ্যতা লাভের পাশাপাশি চলে তার জীবিকা। সেখান থেকে বাচোনো পয়সাতেই আজকের পথে এগিয়ে চলা।

১৯৯০ সালে পিতৃমৃত্যুর পর পরিবারের সম্পদ-সম্পত্তি হিসেবে একটি গরু পান সিদ্দিক মোড়ল। বকুলের সুবাস ছড়ানোর নেশাকে বিস্তৃত করতে বকুল চারার একটি নার্সারি করার পরিকল্পনা করেন তিনি। সে লক্ষে স্থানীয় জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে বছরে দুই হাজার টাকায় ১০ কাঠা জমি ইজারা নিতে গরুটি ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাকি ৫০০ টাকা পরিশোধ করেন শাক-সব্জি বিক্রি করে। এরপর ৭০ টাকায় সাত কেজি বকুলের বীজ কিনে তা বোনেন ওই জমিতে। নিবিড় পরিচর্যায় বীজের অঙ্করোদ্গম এরপর চারাগুলোর বেড়ে ওঠা।

এদিকে বছর না পেরোতেই বাধে বিপত্তি। ইজারার জমি মালিকের ভাইদের মধ্যে জমির মালিকানা নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব । একপর্যায়ে তারা সিদ্দিককে দু’ দিনের মধ্যে তাদের জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেন। তখন জমিতে প্রায় সাত হাজার বকুলের চারা ছিল। দিশেহারা সিদ্দিক চারাগুলো তুলে নিয়ে চলে যান পাশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজে। সেখানে নাম মাত্র মূল্যে কিছু চারা বিক্রি করেন। বাকি চারা বিনা মূল্যে বিতরণ করেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিছু চারা নিজ হাতে রোপণ করেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও সড়কের দু’ পাশে।

তবে এতেও নিরাশ হননি,দমে যাননি লক্ষ্য থেকে। ফের নতুন ইজারায় ভিন্ন জায়গায় জমি নিয়ে বকুলগাছের নার্সারি গড়ে তোলেন সিদ্দিক। নতুন উদ্যমে নতুন ধারায় সেই নার্সারির চারায় সুবাস ছড়াচ্ছে ১২ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন এলাকায়।

এত কিছুর পরও থেমে নেই তার স্বপ্ন দেখা। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঘণ ঘণ বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর মিছিল ছোট করতে এবার তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে তালের চারা লাগানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। চলতি বছর তিনি তাল কিনে গাছে পাকিয়ে তা থেকে উৎপাদিত  চারা বিভিন্ন অঞ্চলের সড়ক ও ওয়াপদার রাস্তায় লাগাবেন। যার উৎপাদিত তাল একদিন পথচারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কুড়িয়ে খাবেন। সবচেয়ে বড় কথা,ঝড় ও বজ্রপাতের কবল থেকে মানুষ প্রাণে বাঁচবে বলে আশা তার।

এর আগে তার বকুল প্রীতি নিয়ে বিটিভি’র জনপ্রিয়  ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে এবং ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হয়।

মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) আরেক স্বাস্থ্যের ফেরীওয়ালা পাইকগাছা সেনেটারী কর্মকর্তা উদয় কুমার মন্ডলের কপিলমুনিতে ফেরী করে শাক বিক্রিকালে আকষ্মিক তার সাথে দেখা হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন দুজনই। বিষয়টি নজর এড়ায়নি উপস্থিত অনেকের। যথারীতি সিদ্দিক উচ্চ স্বরে উপ-শহরবাসীকে জানান দিচ্ছিলেন,আছে ব্রিমি শাক—–নেন ব্রিমি শাক— ব্রেন ভাল হবে—-লাগবে ব্রিমি শাক—–। এসময় চলতে পথে সিদ্দিকের সাথে ঐ কর্মকর্তাকেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে উপস্থিতিদের ব্রিমি কিনতে এর উপকারিতা সম্পর্কে জানান দিতে দেখা যায়। এসময় স্বাস্থ্য সচেতনতায় সিদ্দিকের কাছ থেকে দু’আটি ব্রিমি কিনতেও  দেখা যায় স্বাস্থ্যের ফেরীওয়ালা উদয় মন্ডলকে।

বেঁচে থাকুক সিদ্দিক গাজীরা,বেঁচে থাকুক তাদের স্বপ্নগুলো। নতুন স্বপ্নে সুবাসিত হোক দেশময়। সিদ্দিক গাজীদের অনুপ্রেরনায় উদ্ভাসিত হোক সুন্দর আগামী।