প্রণোদনায় ভর করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে

0
272

খুলনাটাইমস অর্থনীতি : তলানিতে নেমে আসার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি। গত জুলাই মাস শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২০১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে গত দশ বছরে বেসরকারি খাতে ঋণের তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, গত জুন মাসের মত এত কম প্রবৃদ্ধি এক দশকে হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসেই সর্বনিম্ন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও এই একই লক্ষ্য ধরা ছিল, বিপরীতে ঋণ বেড়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকার এক লাখ কোটির বেশি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক ও ব্যাংকাররা। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “মহামারীর ধাক্কা আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করেছে। আমদানিও বাড়ছে। প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। “সব মিলিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছে। তবে পুরোপুরি সচল হতে কত সময় লাগবে- তা এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। কেননা মহামারী কাটিয়ে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে- তা কেউ কিছু বলতে পারছে না।” ২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, “বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি ঋণ। সেই ঋণ যদি না বাড়ে তাহলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে না। কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। “বেশ কিছু দিন ধরে দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে তা আরও নাজুক হয়েছিল। এখন ভালো খবর যে, নতুন অর্থবছরের শুরুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি শুরু হল। আমরা প্রত্যাশা করব, আগামী দিনগুলোতেও যেন এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে।” গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০-২১ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ; যার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য হচ্ছে যথাক্রমে ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সরকারি খাতের তুলনায় কম দেখালেও টাকার অংকে বেসরকারি খাতের জন্য প্রক্ষেপিত মোট ঋণের পরিমাণ সরকারি খাতের তুলনায় অনেক বেশি হবে। চলমান করোনাভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন বিনিয়োগ জোরদার করতে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, জুলাই মাস শেষে দেশে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২০১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সরকার নিয়েছে এক লাখ ৯৬ হাজার ৬৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গত বছরের জুলাই শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৩৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যার মধ্যে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। আর সরকারের ঋণ ছিল এক লাখ ২৯ হাজার ৯৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ হিসাবে জুলাই শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। সরকারি ঋণের ৫১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আর বেসরকারি খাতের ৯ দশমিক ২০ শতিাংশ। কিছু ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে দুই বছর আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে ঋণ প্রবৃদ্ধি। ওই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের শুরুতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। এর মধ্যে কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন পর্যন্ত শতাধিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। কমানো হয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর), নীতি সুদহার রেপো ও ব্যাংক রেট। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণসুবিধা নিয়ে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য যথা সময়ে শুরু করা যায়, সেজন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহামারী মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত এক লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার যে ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং কটেজ মাইক্রো ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (সিএমএসএমই) ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল অন্যতম। এই দুই তহবিলের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা (১৫ হাজার ও ১০ হাজার কোটি টাকা) যোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০ অগাস্ট পর্যন্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্যাকেজ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার মত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এক হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান এই ঋণ পেয়েছে। অন্যদিকে সিএমএসএমই খাতে তিন হাজার কোটি টাকা বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে আগের চেয়ে বেশ গতি এসেছে। প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে বার বার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। “যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরুও করেছে অর্থনীতিতে। স্থবির আমদানি ও রপ্তানিতে গতি আসছে। রেমিটেন্সে-রিজার্ভে রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে। এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেই অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।” গবেষক আহসান মনসুর বলেন, “এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ। বেশ কিছু দিন ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম। তার ওপর ব্যাংক থেকে সরকার প্রচুর ঋণ নেওয়ায় এই প্রবাহে আরও টান পড়ে। “বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ, তারল্য সঙ্কট, নয় ও ছয় শতাংশ সুদ হারের ‘চক্করে’ বেসরকারি ঋণের গতি ছিল বেশ মন্থর। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে গত অর্থবছর শেষে তা আরও নিম্নগামী হয়।” গত সাত-আট বছর ধরে দেশে বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ থেকে ৩৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আহসান মনসুর বলেন, “সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কঠিন এই পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতেই হবে। সেজন্য যদি ভালো উদ্যোক্তাদের আরও প্রণোদনার প্রয়োজন হয় সেটা দিতে হবে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ যথা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।” গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার মোট ৬১ হাজার ৯০৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ২৬৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার।