‘প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে করে ওদের বেঁচে থাকা : শীতের প্রকোপ কেড়েছে ঘুম’

0
1657

কামরুল হোসেন মনি :
বুধবার রাত পৌনে ১১টা। পৌষের ২১। উপরে টিন, চার পাশে খোলা। সামনে নদী। শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে হিমেল হাওয়া। অক্টোপাসের মতো ধেয়ে আসছে শীতের সাঁড়াশি আক্রমণ। এরকম প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে করে মায়ের সাথে গলা ধরে শুয়ে আছে অবুঝ শিশু সন্তানটি। শিশুটির বয়স ৫-৬ বছরের ওপরে না। মেঝেতে প্লাস্টিক বস্তা, গায়েও জড়ানো, তার ওপরে রয়েছে ময়লামাখা মশারী। এসব দিয়ে শীতকে কাবু করতে পারছে না ওরা। এখনো কেউ শীতবস্ত্র নিয়ে পৌঁছায়নি। শীতের পাশাপাশি হিমেল হাওয়ার রাতে খোলা আকাশের নিচে ওদের বেঁচে থাকাই কষ্টদায়ক। প্রকৃতির যেন এদের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
নগরীর বিআইডব্লিউটিএতে বুধবার রাতে প্লাটফর্মে এরকম ভাবেই শিশু সন্তানকে নিয়ে মায়ের রাত্রিযাপন। শুধু এরাই না এমন পরিস্থিতিতে শীতের তীব্রতায় ঘুম কেড়ে নিছে অনেকের। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও মধ্যবয়সী মহিলা-পুরুষরাও রয়েছেন। এসব মানুষেরা হতদরিদ্র, দিনমজুরি করে দিন-আনে দিন খায়। এদিকে খুলনাঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্য-প্রবাহ বইছে। আগামী ২-১ দিন এরকমই অবহাওয়া বিরাজমান থাকবে। এছাড়া চলতি মাসে আরও একটি শৈত্য-প্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে।

এক মা ও তার সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নিদ্রাহীন, খুলনা রেলশেষ্টশন থেকে বুধবার রাত পৌনে ১১ টায় ছবিটি তোলা হয়..খুলনাটাইমস

খুলনা আবহাওয়াবীদ আমিরুল আজাদ বৃহস্পতিবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে খুলনাঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্য-প্রবাহ বইছে। এরকম আরও ১-২ দিন থাকবে। গত ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে খুলনাঞ্চলে তাপমাত্রা ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি কমে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আছে। এর পাশাপাশি বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৫-৬ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তার দেওয়া তথ্য মতে, বুধবার খুলনাঞ্চলে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৫৮ ডিগ্রি সেঃসিঃ ও সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার দুপুরে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বোচ্চ ছিল ২০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশের তুলনায় বৃহস্পতিবার খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলিসিয়াস ও যশোরে ছিল ৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবীদ আমিরুল ইসলাম বলেন, মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্য-প্রবাহ আগামী ১-২ দিন অব্যাহত থাকবে। শীতের সাথে সাথে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি। এই মাসে আরও একটি মৃদু থেকে মাঝারি অথবা তীব্র শৈত্য-প্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখার সূত্র মতে, গত ১২ ডিসেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৯২০টি কম্বল এসেছে। যা দুই পৌরসভা ও জেলার ৯ উপজেলায় ইতোমধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিতরণের জন্য। এর মধ্যে দাকোপে ১ হাজার ১৪১টি, বটিয়াঘাটা ১ হাজার ১৭০টি, দিঘলিয়ায় ৭৬৩টি, রূপসায় ১ হাজার ১১৩টি, ফুলতলায় ৪৭৫টি, কয়রা ১ হাজার ৬০২টি, পাইকগাছায় ১ হাজার ৭৬৯টি, তেরখাদায় ৯৭৪টি ও ডুমুরিয়ায় ১ হাজার ৯১৩টি কম্বল সংশ্লিষ্ট ইউএনও কাছে পৌঁছে গেছে। তবে খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে শীতার্তের মাঝে কোন কম্বল বরাদ্দ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ত্রাণ তহবিল থেকে আরও ২৩ হাজার ৭৫টি কম্বল বরাদ্দ হয়েছে। আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে খুলনায় এসে পৌঁছাবে।
জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখার কর্মকর্তা খুলনার (ডিআরআরও) আজিজুল হক জোয়ার্দার বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, ইতোমধ্যে জেলার ৯ উপজেলায় ১০ হাজার ৯২০টি কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেগুলো সংশ্লিষ্ট ইউএনও এর মাধ্যমে তা পৌঁছে গেছে। তারা এলাকায় শীতার্তের মাঝে বিতরণ করবেন। এছাড়া আরও ২৩ হাজারের মতো কম্বল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খুলনার জন্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকার জন্য কোন বরাদ্দ নেই, পূর্বে কোন দিনও ছিলো না।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সরদার আবু তাহের বলেন, এই কর্পোরেশনে সরকারিভাবে কোন কম্বল বরাদ্দ নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দেওয়া কিছু কম্বল পেয়ে থাকি। তা সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।
বুধবার (৩ জানুয়ারি) রাতে নগরীর বিআইডাব্লিউটিএ ও রেলস্টেশনে গেলে চোখে পড়ে হাড় কাঁপানো শীতে কষ্ট ভোগ করছেন খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষগুলো। শ্রমজীবী ওইসব মানুষরা রাস্তায় বেরলেও তাদের কষ্ট ছিল অসহনীয়। ওই রাতে কথা হয় কয়েকজনের সাথে। এর মধ্যে আলেয়া, মাসুমা খাতুন ও বৃদ্ধ ইউনুস সরদারের সাথে। তাদের কোন ঘর নেই, যেখানে দিন সেখানেই রাত। কেউ বা স্থায়ীভাবে এখানে একটু থাকার জন্য ঠাঁই করে নিয়েছেন। হতদরিদদ্র গৃহবধূ হালিমা জানান, রূপসা ও শহরের মধ্যে খাবারের হোটেলে গিয়ে থালা-বাসন মেজে কয়টা ভাত পাই। মেঝেতে প্লাস্টিক চটের বস্তা বিছিয়ে ও গায়ে পুরনো কাপড় দিয়ে কোন রকম শীতকে মানানোর চেষ্টা করছি। আপনারা ছবি তুলে নিচ্ছেন, বড় লোক আমাগো একটা মোটা কম্বলের ব্যবস্থা করে দেন। গতবার যা পাইছি তা খুবই পাতলা। এতে শীত মানে না। চোখে ঘুম থাকলেও শীতে ঘুমাইতে পারি না। বেশি বিপাকে পড়েছে সহায় সম্বলহীন হতদরিদ্র পরিবারগুলো। চারপাশে খোলা আকাশের নিচে চারদিক দিয়ে অক্টোপাসের মতো ধেয়ে আসছে শীতের সাঁড়াশি আক্রমণ। আর থরথর করে কাঁপছে ওইসব হতদরিদ্র মানুষগুলো।