পিছিয়ে পড়ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন

0
1310

মোঃ মারুফ গাজী/ফকির শহিদুল ইসলামঃ
এমনিতেই খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তারপর পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগ না আসায় মুখ থুবড়ে পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন। এদিকে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলনা, মংলা, বাগেরহাটসহ আশপাশ জেলায় তাদের শিল্প স্থাপন করতে চাইলেও পর্যাপ্ত সুবিধার অভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এতে পিছিয়ে পড়ছে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন। তবে সরকারের সহযোগিতায় অচিরেই সব সংকট কাটিয়ে এখানকার শিল্প-কারখানার অতিত গৌরবে ফিরবে প্রত্যাশা খুলনাবাসীর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুলনা বিনিয়োগের জন্য অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ কাঁচামাল, সহজলভ্য শ্রম ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ রয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের সহজে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। এছাড়া সরকার বেনাপোল-ঢাকা ও পায়রা-ঢাকা রুটে শিল্প করিডোর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। যা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, শিল্পপার্ক, পিপিপির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন অর্থনীতির জন্য জরুরী। সরকার সারাদেশে যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে খুলনার তেরখাদা ও বটিয়াঘাটা রয়েছে। এরূপ সমন্বিত কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে সুদিন ফেরাতে পারে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন ।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক খুলনাটাইমসকে বলেন, বাংলার জনগণের আস্থা, জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সর্বদাই বিশেষ নজর রেখেছেন। এজন্যই নগরীর উন্নয়নে সম্প্রতি প্রায় পনের শ’ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন, মংলা বন্দর সচল, তেরখাদা ও বটিয়াঘাটায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, আধুনিক রেলষ্টেশন নির্মাণসহ নানা প্রকল্প এরই স্বাক্ষ্য দেয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার ইতোমধ্যে ভোলা হতে খুলনায় পাইপলাইনে গ্যাস আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী এক বছরের মধ্যেই স্থানীয় শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।

খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক খুলনাটাইমসকে বলেন, এতদ্বাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপন ও উন্নয়নে জ্বালানী শক্তির সংকট মূলত: গ্যাসের জন্যই তৈরি হয়েছে। তবে অচিরেই এই সংকট আর থাকছে না। আশা করছি গ্যাস এসে যাবেই, পটুয়াখালী, ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করার নির্মাণ কাজ দ্রæত সম্পন্ন হতে চলেছে। চেম্বার সভাপতির মতে, খানজাহান আলী বিমানবন্দরটি আমাদের দ্রæত সম্পন্ন হওয়া দরকার, আর রাস্তাঘাটের উন্নয়ন তো হচ্ছেই, এটাও (গ্যাস) হয়ে যাবে শিঘ্রই। এছাড়া খুলনাসহ সারাদেশে রেললাইন সম্প্রসারণের কার্যক্রম তো চলছেই। এগুলো সম্পন্ন হয়ে গেলে আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রæত সময়ের সকল সংকট দূর করে এগিয়ে যাবে, সর্বোপরি খুলনাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ঘটবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অথনীতি ডিসিপ্লিনের প্রধান প্রফসর শাহনেওয়াজ নাজিমুদ্দিন আহমদ খুলনাটাইমস’র এই প্রতিবেদককে জানান সম্ভাবনা থাকলেও জ্বালানি ও শক্তিসম্পদের অভাব এখানে শিল্পায়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। খুলনার রূপসা নদীর তীরবর্তী ফ্রোজেন ফুড ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়ায় ভারী শিল্প স্থাপন না হলেও এ অঞ্চলে হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। চলতি বছরে জেলার বটিয়াঘাটার পানখালিতে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস যৌথ উদ্যোগে এলপিজি গ্যাস বোতলজাতকরণ প্রকল্পের নিবন্ধন হয়েছে।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ-জামান খুলনাটাইমস’র এই প্রতিবেদককে জানান, যারা বিনিয়োগকারী তারা বিনিয়োগ করতে গেলে প্রথমত কয়েকটি জিনিস চায়। প্রথম জ্বালানি সমস্যার সমধান, তারপর যোগাযোগ অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, অতঃপর সে শিল্প বিনিয়োগ করে। জ্বালানি সংকটের কারনে খুলনায় কোন কাঙ্খিত বিনিয়োগ হয় না এবং শিল্প কলকারখানা স্থাপনে যারা বিনিয়োগকারি তারা এখানে শিল্প স্থাপন করতে চায় না। খুলনায় পাইপ লাইন বসানো হয়ে গেছে আড়ংঘাটা পর্যন্ত। সুতরাং যতদিন ভোলা হয়ে গ্যাস না আসে, ততদিন পর্যন্ত আমরা আড়ংঘাটার গ্যাস ব্যবহার করে শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলতে পারি। তার জন্য যে পাইপ গুলো আসছে সে গুলো দ্রুত স্থাপন করা হোক।

প্রসঙ্গত: বিগত দুই দশকেও এখানকার চালু থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের আধুনিকায়ন নেই, কোন অগ্রগতি মেলেনি লবণ শিল্পের উন্নয়নে, বন্ধকৃর্ত নিউজপ্রিন্ট-হার্ডবোর্ড-টেক্সটাইল মিল চালু অথবা এ সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের অব্যাবহৃত জমিতে নতুন কোন শিল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। অন্যদিকে ঈশ^রদী-ভেড়ামারা গ্যাস সঞ্চালন লাইন প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ফলে খুলনা-বাগেরহাটের মংলায় শিল্পের অতিরিক্ত বিনিয়োগ কমেছে। এছাড়া নড়াইল চুয়াডাঙ্গা মাগুরা ও মেহেরপুর বিনিয়োগ প্রায় শূন্য । পদ্মা সেতু নির্মানকে কেন্দ্র করে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপার সম্ভাবনা থাকলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নানামূখি সংকটে সরকারী /বে-সরকারী বিপুল পরিমান বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন আলোর মূখ দেখছে না অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
শিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, যোগাযোগ ও ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় সরকারকে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আর অর্থনীতিবিদ-গবেষকরা মনে করেন, খুলনায় শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-গ্যাসের অভাব, বিপণনে জটিলতা, কাঁচামালের উচ্চমূল্য, অসম প্রতিযোগিতা ও দুর্বল আইনী কাঠামোসহ ৯ ধরণের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রয়েছে সরকারের আন্তরিকতার অভাবও।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বিগত আট বছরে খুলনা-বাগেরহাটে নিবন্ধিত শিল্পের মূল বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালে শুধুমাত্র খুলনা জেলায় মূল বিনিয়োগ ছিল ৮০০ কোটি টাকা ও অতিরিক্ত বিনিয়োগ ৫৮৩ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৬ সালে মূল বিনিয়োগ ২২২৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেলেও অতিরিক্ত বিনিয়োগ ৪০০ কোটি টাকা কমেছে। একই সময়ে বিভাগের নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও মেহেরপুর ছিল একপ্রকার বিনিয়োগ শূন্য। বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের মতে,পাইপলাইনের গ্যাস না থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রামের তুলনায় এখানে শিল্প পণ্য উৎপাদনের ব্যয় তুলনামূলক বেশি। এ কারণে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।

জানা যায়, বিগত এক যুগে খুলনায় ৩০১টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফুড অ্যান্ড এলাইড প্রোডাক্টস্ উৎপাদনের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৬০টি প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রকৌশল শিল্প, নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা ৪৯টি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল শিল্প, নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা ৪৩টি। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পাট ও বস্ত্রশিল্পে জাতীয়করণকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে দিনকে দিন অর্থ সংকটে মুখ খুবড়ে পড়ছে, সেখানে সফলভাবে বেসরকারি খাতে পাট ও বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগ এগিয়ে চলছে এবং রপ্তানীও বৃদ্ধি পাচ্ছে।