পাইকগাছায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ

0
217
  • ৩ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে বিসিআইসির ১১ ডিলার
    শেখ নাদীর শাহ্:
    চলতি বোরো মৌসুমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে খুলনার পাইকগাছায় সারের দাম বাড়িয়েছে বিএডিসি ও বিসিআইসির ডিলাররা। তিনটি ব্যবসায়ী পরিবারের যৌথ সিন্ডিকেটের কাছে পুরো কৃষিই যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে। একদিকে করোনায় অর্থ সংকট অন্যদিকে কৃষিতে সারের প্রয়োজন, দুইয়ে মিলে চরম দূর্ভোগে পড়েছেন কৃষকরা। প্রতিবাদ করলে সার নেই, ডিলারদের এমন সাফ জবাবে রীতিমত চরম দূর্ভোগে পড়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে চাষাবাদের ভরা মৌসুমে সঠিক সময়ে জমিতে সার প্রয়োগ যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকদের জন্য।
    তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, কৃষকরা যাতে সময়মতো জমিতে সার দিতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে সরকারের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) সারা দেশের ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে সার বিপণনের কাজটি করে থাকেন। এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা সার বিপণনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও ডিলার নিয়োগ করেন তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশের জেলা-উপজেলায় ‘সার-বীজ বিতরণ ও ম‚ল্যায়ন কমিটি’র সার বিতরণ কার্যক্রম সমন্বয় করেন।
    উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা পদাধিকার বলে এই ম‚ল্যায়ন কমিটির প্রধান। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। পাইকগাছায় ডিলাররা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কৃষকদের বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য করছে। এক্ষেত্রে মনিটরিং কমিটিও কার্যত কোন প্রকার ভূমিকা রাখছেননা।
    কৃষকরা জানান, বোরো আবাদে বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে চারা রোপনের পর এখন দ্বিতীয় দফায় সার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চলছে গ্রীষ্মকালীন সব্জি চষের মৌসুম। চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই সকল প্রকার সারের সরকার নির্দ্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। ডিলারদের পক্ষে সংকট বা সরবরাহ না থাকার বিষয়টি জানানো হলেও অধিক দামে বিক্রি বন্ধ নেই একদিনের জন্য হলেও। কৃষকরা বলছেন, সংকট থাকলে অতিরিক্ত দামে ডিলারদের সারের উৎস্য কোথায়?
    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সার ডিলারদের অনেকেই জানান, সারের পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকে অতিরিক্ত দামে সার ক্রয় করায় বাধ্যতামূলক সরকার নির্দ্ধারিত মূল্যের বাইরে সার বিক্রি করতে হচ্ছে। তাছাড়া এলাকায় চিকন দানার ইউরিয়ার চাহিদা বেশি থাকলেও মূলত তাদেরকে ইচ্ছানুযায়ী মোটা দানার ইউরিয়া সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে দাম বেশি দিলে জোটে চিকনদানার ইউরিয়া। বিএডিসি ও বিসিআইসির পাশাপাশি সাব ডিলাররা সরকার নির্ধারিত সারের খুচরা মূল্য তালিকা দোকানে টানিয়ে রেখে প্রকাশ্যে অধিক দামে সার বিক্রি করলেও কৃষিকর্মর্তারা বলছেন, তাদের কাছে কৃষকদের পক্ষে কোন অভিযোগ-অনুযোগ কিংবা পর্যাপ্ত প্রমানাদি নেই। প্রমান স্বরুপ তারা দোকানের বিক্রি রশিদ বা প্রমানপত্র চান। এদিকে ডিলারদের পক্ষে খুচরা বিক্রেতাদের নাকি কোন রশিদ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। তারা বড় জোর সাব ডিলারদের চালান দিয়ে থাকেন। তাছাড়া ডিলাররা যেখানে মূল্য তালিকা টানিয়ে রেখে প্রকাশ্যে বেশি দামে কৃষকদের সার কিনতে বাধ্য করছেন, সেখানে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করলেও রশিদে সরকারি দামের বাইরে অতিরিক্ত দাম উল্লেখ করার কথা না। এই সাধারণ বিষয়টিই বুঝতে চাইছেন না উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা।
    ধারণা করা হচ্ছে, সিন্ডিকেটটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে পরোক্ষ সহায়তা নিয়েই কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফায়দা নিচ্ছে।
    তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, বোরোর ক্ষেতে এখন ম‚লত ইউরিয়া ও পটাশ সারের প্রয়োজন, গ্রীষ্মকালীন সব্জি ক্ষেতে ইউরিয়া এবং টিএসপি/ডিএপি, ভুট্টা চাষে প্রয়োজন পটাশ সার। চলতি ফাল্গুন ও আসন্ন চৈত্র মাসে পাট চাষের জন্য প্রয়োজন ইউরিয়া, টিএসপি/ডিএপি আর পটাশ। সব মিলিয়ে চলতি ভরা ও আসন্ন কৃষি মৌসুমে সারের চাহিদাকে পুঁজি করে পাইকগাছায় কৃত্রিম সংকটে সারের দাম বৃদ্ধি করেছেন ডিলাররা।
    জানা যায়, সারের সরকার নির্ধারিত ম‚ল্য হলো ইউরিয়া প্রতি বস্তা ৮০০ টাকা, এমওপি প্রতি বস্তা ৭৫০, ডিএপি প্রতি বস্তা ৮০০ এবং টিএসপি প্রতি বস্তা ১ হাজার ১০০ টাকা। চাষিদের অভিযোগ, ডিলাররা বস্তাপ্রতি ইউরিয়ায় ১০০, এমওপি ২০০, ডিএপি ১০০ এবং টিএসপিতে প্রকারভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত ইচ্ছা মাফিক অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন। দীর্ঘ দিন যাবৎ পাইকগাছায় বিএডিসি ও বিসিআইসি ডিলারগুলো মূলত তিনটি পরিবারের নিয়ন্ত্রনে পরিচালিত হওয়ায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই তারা নিয়ন্ত্রণ করেন সার-বীজের বাজার দর। কৃষকরা জানান, গেল বছর ধানের বীজেও তারা সংকট সৃষ্টি করে দ্বিগুণ, তিন গুণ কখনো চারগুণ পর্যন্ত বেশি দামে বীজ বিক্রি করেছেন।
    সূত্র জানায়, ক্রেতাদের কেউ রসিদ দাবি করলে তাদেরকে সরকার নির্ধারিত দাম উল্লেখ করেই রশিদ দেওয়া হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার কাছে সার বিক্রি করছেন না তারা। বলছেন, এ্যানাউন্স বা বরাদ্দের সার শেষ, এখন যা আছে বাইরে থেকে অতিরিক্ত দামে কিনতে হয়েছে। কৃষক বা ক্রেতা বাঁচাতে তারা শুধুমাত্র উপকার করছেন। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, ডিলাররা তাদের স্ব স্ব দোকানে অল্প কিছু সার প্রদর্শনীর জন্য রাখলেও বেশিরভাগ ডিলার তাদের গুদাম থেকে গোপনে সার বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ কৃষকদের।
    অভিযোগে জানাযায়, পাইকগাছায় ১০ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভায় মোট ১১ টি ডিলার মূলত কপিলমুনি কেন্দ্রীক দু’টি ও গজালিয়া কেন্দ্রীক ১টিসহ মোট ৩ টি পরিবার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এরমধ্যে পাইকগাছা পৌরসভায় প্রফুল্ল সরদারের মৃত্যুতে তার ছেলে হিমাদ্রী সরদার মেসার্স বীরেন্দ্র নাথ সরদার নামে ডিলার নিলেও কপিলমুনির পাল ট্রেডার্স সেটি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসা পরিচালনা করেন। উপজেলার ১ নং হরিঢালী ইউনিয়নে কপিলমুনির নাছিরপুর গ্রামের মৃত বৈদ্যনাথ পালের ছেলে রাম প্রসাদ পাল মেসার্স পাল ট্রেডার্সের নামে, ২নং কপিলমুনি ইউনিয়নে স্থানীয় রেজাকপুরের নূর ইসলাম খাঁ মেসার্স আল আমিন ট্রেডার্সের নামে, ৩ নং লতা ইউনিয়নে গজালিয়ার আজহারুল ইসলাম লাভলু মেসার্স লাভলু ষ্টোর, গদাইপুরে কপিলমুনির নাছিরপুরের মৃত বৈদ্যনাথ পালের ছেলে ভরত চন্দ্র পাল মেসার্স সার বিপনী নামে, রাড়লীতে কপিলমুনির রেজাকপুরের নূর ইসলাম খানের ছেলে মোঃ মহসিন খান মেসার্স খান ট্রেডার্স নামে, চাঁদখালীতে নূর ইসলাম খানের আরেক ছেলে মোখলেছুর রহমান খান মেসার্স আল্লার দান ট্রেডার্সের নামে, গড়ুইখালীতে কপিলমুনির বৈদ্যনাথ পালের আরেক ছেলে লক্ষণ পাল মেসার্স শাপলা ট্রেডার্সের নামে, দেলুটিতে বিজন কুমার হালদার মেসার্স পাইলট ট্রেডার্সের নামে, লস্কর ইউনিয়নে গজালিয়ার আজহারুল ইসলাম লাভলুর ভাবি মোছাম্মাৎ কদবানু খাতুন জুবায়ের ষ্টোর নামে, সোলাদানা ইউনিয়নে আজহারুলের স্ত্রী মোছাম্মাৎ রেক্সোনা খাতুন ইসমাইল বীজ ভান্ডার নামে ডিলারশীপ নিয়ে একক ভাবে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
    মূলত উপজেলার ১ টি পৌরসভা ও ১০ টি ইউনিয়নে কপিলমুনির নাছিরপুর গ্রামের বৈদ্যনাথ পালের ৩ ছেলে রামপ্রসাদ পাল, লক্ষণ চন্দ্র পাল ও ভরত চন্দ্র পাল যথাক্রমে হরিঢালী, গদাইপুর, গড়–ইখালী ও পৌরসভায় হিমাদ্রী সরদারের মেসার্স বীরেন্দ্র নাথ সরদার নামে পাল ট্রেডার্স ব্যবসা পরিচালনা করেন। কপিলমুনির আরেক ব্যবসায়ী নূর ইসলাম খান ও তার দু’ছেলে যথাক্রমে মহসিন খান ও মোখলেছুর রহমান খান ৩টি ইউনিয়ন কপিলমুনি, রাড়লী ও চাঁদখালী ইউনিয়নে ব্যবসা পরিচালনা করেন। এছাড়া গজালিয়ার আজহারুল ইসলাম লাভলু নিজে লতায় ও তার স্ত্রীর নামে সোলাদানা ও লস্করে ভাবির নামে ডিলারশীপ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। সার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সার নিয়ে অচলাবস্থা প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চললেও স্থানীয় কৃষি বিভাগকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অনেক ডিলারের নামে তারাই সার তুলে বিক্রি করে থাকেন।
    এব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা কৃষি অফিসার মো: জাহাঙ্গীর আলম গত ১৪ জানুয়ারী বিসিআইসি, বিএডিসি ও খুচরা সার ডিলারদের উদ্দেশ্যে এক নির্দেশনায় জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি, খুলনা ও অতিরিক্ত উপ পরিচালক (উদ্যান) উপজেলার সার বিক্রয় কেন্দ্র পরিদর্শণে নানা অসংগতি ও উপজেলা কৃষি অফিসার নিজে উপজেলার বাঁকা বাজারে পরিদর্শনে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে সার বিক্রির অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এরপরও কার্যত অদ্যবধি তিনি সারের বাজার নিয়ন্ত্রনে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেননি।
    এপ্রসঙ্গে পাইকগাছা উপজেলা কৃষি অফিসার মো: জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে এ প্রতিনিধিকে বলেন, এই মূহুর্তে পাইকগাছায় সারের কোন প্রকার সংকট নেই। তবে বাজার মনিটরিংকালে বিভিন্ন সময় কৃষকদের অনেকেই তার কাছে অধিক মূল্যে সার বিক্রির বিষয়ে অভিযোগ করে থাকেন। যদিও এনিয়ে সুনির্দিষ্ঠ কোন অভিযোগ নেই ডিলারদের বিরুদ্ধে। এসময় তিনি বলেন, কৃষকদের একটি অংশ বাকিতে ডিলারদের কাছ থেকে সার ক্রয় করেন, সেক্ষেত্রে দর-দামে কিছুটা তারতম্য থাকতে পারে বলেও মন্তব্য তার। তবে উপজেলার ১০ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৩টি পরিবার কর্তৃক বিসিআইসির ১১ টি ডিলার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি স্বীকার করে তিনি জানান, বেশ আগে থেকেই তারা ডিলার নিয়ে ব্যবসা করছেন। বাজার মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে,কারোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ঠ অভিযোগ প্রমানিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
    বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন’র (বিএডিসি) মহাব্যবস্থাপক গাজী আব্দুস সাত্তারের কাছে সরকার নির্দ্ধারিত মূল্যের অধিক দামে সার বিক্রির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
    সর্বশেষ চাষাবাদ মৌসুমে সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কৃষকদের কাছে বিভিন্ন সারের অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির ঠেকাতে ভূক্তভোগী কৃষকরা তৃণমূল পর্যায়ে মনিটরিং জোরদারপূর্বক ডিলারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানান।