নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই চলছে খানজাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়

0
3115

ফকির শহিদুল ইসলাম: খুলনায় খানজাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় সহ ২০টি বেসরকারি পলিটেকনিকগুলো বেশীর ভাগই কারিগরি শিক্ষার বিদ্যমান নীতিমালার তোয়াক্কা করছে না। ফলে খুলনায় অবস্থিত ২১টি বেসরকারি পলিটেকনিকের মধ্যে মাত্র দু একটির মান ভালো। বাকিগুলোর মান নিয়ে খোদ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডই সন্দিহান। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। অভিযোগ রয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী মানহীন পলিটেকনিকগুলোর কাছ থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকে। ফলে ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। আর পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর মান তদারকিতে ব্যর্থ হলেও নতুন করে একের পর এক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। গত এক বছরে খুলনায় অনুমোদন পেয়েছে আরো ৩ টি নতুন বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনা মহানগরীর মূজগুন্নী আবাসিক এলাকার বয়রা মহাসড়কে অবস্থিত খানজাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয় । প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পার হলও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারেনি এ প্রতিষ্ঠানটি। চাকচিক্য চটকদার বিজ্ঞাপন লোভনীয় সুযোগ সুবিধার কথা বলে এ অঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীদের আকৃষ্ট করে ভর্তি করায়। আবার এই ভর্তি বানিজ্যের জন্য সরকারী খুলনা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এর আশপাশ এলাকার কিছু শিক্ষক ও কোচিং সেন্টার রয়েছে কমিশন ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের কমিশন। যারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মার্কেটিং এর কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানটির বাহিরে চাকচিক্য অথচ ভিতরে কারিগড়ি বোর্ডের নীতিমালার কোন সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। তাদের চটকদারি বিলিকৃত লিফলিট এ দেখা যায় তাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নামে অঙ্গ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে । যেমন খান জাহান আলী জুট এন্ড টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, খুলনা মেডিকেল ইন্সটিটিউট, শাহাপুর সড়কে খানজাহান আলী কৃষি কলেজ, বাগেরহাটে খানজাহান আলী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, খানজাহান আলী মেডিকেল ইন্সটিটিউট, সাতক্ষীরায় খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও সাতক্ষীরায় খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ মেডিকেল ইন্সটিটিউট এই রকম বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতারনার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কারিগরি বোর্ড এবং স্টেপ এর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি গ্রান্ড পেয়েছে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা।
সরকার কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক এর আর্থিক সহায়তায় স্কিলস এন্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রোজেক্ট এর আওতায় কারিগরি ছাত্র ছাত্রীদের মাসিক ৮০০ টাকা হারে বৃত্তি প্রদান করে আসছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠান বৃত্তির টাকা নিয়ে নয়ছয় করছে এমন অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্র ছাত্রীরা।
অত্র প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় শুধুমাত্র সেকালে কয়েকটি ল্যাব আছে। সেই ল্যাবেও নেই কোন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। অত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের ভাষ্যানুযায়ী ১৬ টি টেকনোলজির বিপরীতে ১৬ টি ল্যাব আছে। যেখানে ধারা অনুযায়ী প্রতিটি টেকনোলজির বিপরীতে ৫টি পৃথক ল্যাবরেটরি/ওয়ার্কশপ থাকতে হবে। যার কিছুই নেই এই প্রতিষ্ঠানের। অথচ বাস্তবে দেখা যায় মাত্র ৬টি ল্যাব কম্পিউটার ল্যাব, মেরিন/মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্টনিক্স, ড্রইং রুম, টেক্সটাইল ল্যাব, ফিজিক্স/ক্যামিস্ট্রি ল্যাব। এই ল্যাবগুলোর মধ্যে প্রায় চার হাজার ছাত্রের বিপরীতে মাত্র ১৮ টি কম্পিউটার সম্বলিত কম্পিউটার, হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কিং ল্যাব। আর অন্যান্য ল্যাবে ছোট খাটো টুলস ছাড়া কিছুই নাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাধ্যক্ষ আসীষ কুমার বলেন, আমাদের বাকি ১০টি ল্যাব ভিন্ন জায়গায় আছে। যেগুলো শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে। এই প্রতিষ্ঠানটি গেলো বছর সরকার কর্তৃক ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা গ্রান্ট পেয়েছে কারিগরি শিক্ষার মানউন্নয়নে খরচ করার জন্য। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বিভিন্ন ট্রেনিং, জব ফেয়ার, জব প্লেসমেন্ট সেলের মাধ্যমে চাকুরী প্রদান, স্কিলস কম্পিটিশন, গেষ্ট স্পিকারের মাধ্যমে শিক্ষা দান, শিক্ষকদের বিদেশ ট্যুর সহ আরো কিছু ট্রেনিং কাজে খরচ করেছে সিংহ ভাগ টাকা। অথচ তাত্তি¡ক ও ব্যবহারিক কাসে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কিছুই করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। বিভিন্ন কোর্সের পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ড চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং অনুমোদন দিয়ে থাকে। দেশে কর্মরত বেসরকারি পলিটেকনিকগুলোর মান তদারকির জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শকের নেতৃত্বে একাধিক কর্মকর্তা রয়েছে। তাদেরই নিয়মিত ওসব প্রতিষ্ঠানের মান দেখার কথা। কিন্তু নানা অজুহাতে ওই কর্মকর্তারা নিয়মিত বেসরকারি পলিটেকনিকগুলো পরিদর্শনে যায় না। আবার পরিদর্শনে গেলেও উপরি পেয়ে তারা চলে আসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে কারিগরি শিা বোর্ডের পরিদর্শকরা এমন অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের দাবি, যখন পরিদর্শনে যাওয়া হয় তখন দেখা যায় যন্ত্রপাতি, ল্যাব সাজানো। কিন্তু পরিদর্শন শেষে সেগুলো আবার নিয়ে যাওয়া হয়। আর হাতেনাতে প্রমাণ না পাওয়ার কারণে ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বেসরকারি পলিটেকনিকের প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে। বোর্ডের নীতিমালায় দেখা যায়, একটি পলিটেকনিকের জন্য ১৫০ থেকে ২শ বর্গফুট বিশিষ্ট ৯টি সাধারণ কক্ষ, প্রতিটি টেকনোলজির জন্য ৪টি শ্রেণিক, শিক্ষকদের বসার জন্য দুটি পৃথক, পদার্থ ও রসায়নের জন্য ২শ বর্গফুটের জন্য ২টি পৃথক কক্ষ থাকতে হবে। আর সিভিল/আর্কিটেকচার কোর্সের জন্য ৪০০ থেকে ৬শ বর্গফুটের ১০টি ল্যাবরেটরি/ওয়ার্কশপ, মেকানিক্যাল টেকনোলজির জন্য ৪শ থেকে ৬শ বর্গফুটের ৮টি, ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজির জন্য ৬টি, ইলেকট্রনিক্স টেকনোলজির জন্য ৫টি, কম্পিউটার টেকনোলজির জন্য ৬টি, পাওয়ার টেকনোলজির জন্য ৫টি পৃথক ল্যাবরেটরি/ওয়ার্কশপ থাকতে হবে। কিন্তু খুলনায় যেসব পলিটেকনিক রয়েছে তার একটিতেও নীতিমালা অনুযায়ী অবকাঠামো সুবিধা নেই বললেই ভুল হবে না।
এ প্রসঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ৪ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভালো নয়। নীতিমালা মানছে না। তবে ভালো মানের কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ভবন তৈরি করেছে। অবশ্য কারিগরি শিক্ষায় উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য নীতিমালার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। তবে এখন কোনো ছাড় দেয়া হয় না। মান বৃদ্ধির জন্য ভবিষ্যতে উদ্যোগ নেয়া হবে। একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে যা খুব শিঘ্রই কার্যকর করা হবে।