নবীন বাংলাদেশের জন্য প্রবীণ বাজেট

0
494
 টামইস্ ডেস্ক:

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিকে সুবিধা দেয়া হলেও মধ্যবিত্তের ওপর বেড়েছে করের চাপ। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য বন্ধ না করে উল্টো করপোরেট ট্যাক্স বাড়ানোর ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে নবীন বাংলাদেশের জন্য প্রবীণ বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে সংস্থাটি বলছে, বিড়াল বড় হতে পারে, বিড়াল ছোট হতে পারে। কিন্তু তাকে ইঁদুর ধরতে হবে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার উচ্চ হতে পারে, প্রবৃদ্ধির হার নিচু হতে পারে। কিন্তু প্রবৃদ্ধিতে গরিব মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হতে হবে, তাদের বেশি পেতে হবে। তবে সেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশে পূর্ব-পশ্চিম ভাগ তৈরি হয়েছে। একদিকে সিলেট-চট্টগ্রাম-ঢাকা অন্যদিকে, বরিশাল-খুলনা-রাজশাহী। একদিকে, উন্নততর বাংলাদেশ, অন্যদিকে, দরিদ্রতর বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি হলেও বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে গরিব মানুষ আরো গরিব হয়েছে, ধনী হয়েছে আরো ধনী। এ জন্য বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘বাজেট পরিকল্পনা’ জরুরি। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটকে রাজনৈতিক অর্থনীতির বাজেট বলে অভিহিত করেছে সিপিডি।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০১৮-১৯ পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংগঠনের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খানসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডি জানায়, স্বল্পমেয়াদি ভালো দিকের মধ্যে রয়েছে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা, সরকারি বিনিয়োগের অব্যাহত বৃদ্ধি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি। স্বল্পমেয়াদি সমস্যার মধ্যে আছে রাজস্ব আদায় বাড়াতে দুর্বলতা, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি, কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া। অন্যদিকে বাজেটের ভালো দিক হলো ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো, স্থানীয় শিল্পের প্রসারে নীতিসহায়তা, প্রতিবন্ধীবান্ধব হাসপাতালের সুবিধা, গরিবের রুটি-বিস্কুট ও পাদুকার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) তুলে নেয়া। এছাড়া সিপিডি মনে করছে, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ এখনো স্থবির হয়ে রয়েছে। কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার এবং গরিবের আয় বৃদ্ধির হার দুর্বল, উৎপাদনশীলতা ও মানবসম্পদের গুণগত মান দুর্বল। এ কারণ বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। উবার, পাঠাওয়ের মতো রাইড সেবা ও ই-কমার্স ব্যবসার ওপর ভ্যাট আরোপের ফলে তরুণদের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হবে। তাদের ওপর করের বোঝা চাপানোতে বিকাশমান কর্মসংস্থানে ধাক্কা লাগতে পারে। একই সঙ্গে তা শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যয় বাড়াবে। তামাকজাত পণ্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক তুলে দেয়ার সমালোচনা করে সিপিডি বলেছে, এটা করা হলে দেশে তামাক উৎপাদন বাড়বে, যা সরকারের তামাক উৎপাদন বন্ধ করা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের লক্ষ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ৭.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য বাজেটে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে হলে ১১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি লাগবে, যা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ করতে হবে। আর এতে করে পুঁজির উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। এটি বাস্তবে করা অনেক কঠিন, এজন্য জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে। তিনি বলেন, ধরা হয়েছে যে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৬ শতাংশ থাকবে, আমরা এটার ব্যাপারে গভীর সংশয় প্রকাশ করছি। কারণ বিশ্ব অর্থনীতির যে পরিস্থিতি এবং দেশের ভেতরে যে প্রবণতা সেটা এটাই বলছে। প্রবৃদ্ধির অঙ্কের বদলে সেই প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন মানে কতটা পরিবর্তন আনতে পারছে- সে দিকে নজর বাড়াতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যার পুঁজি ও সম্পদ আছে তার আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু শ্রম ও উদ্যোগের মূল্য নেই। ধনী-গরিবের বৈষম্যও সামপ্রতিক বছরগুলোতে আগের চেয়ে বেড়েছে। এটা মেধাভিত্তিক অর্থনীতির জন্য ভালো খবর বলে মনে হচ্ছে না।
দেবপ্রিয় মনে করেন, বাংলাদেশে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি হলেও সেটির সুফল সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে পৌঁছতে পারছে না। এ কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমেছে, আর বাড়ছে বৈষম্য। যারা সবচেয়ে গরিব, গত পাঁচ বছরে তাদের ৬০ শতাংশ আয় কমেছে। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের ৫৭.৪ শতাংশ আয় বৃদ্ধি ঘটেছে। গরিব মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের মুখে দেশে সাম্যবাদী সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে বাজেট কতটুকু অন্তর্ভূক্তিমূলক হবে তা নিয়েও সংশয় জানিয়েছে সিপিডি।
বাজেটে ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়ের সীমা না বাড়ানোয় হতাশা প্রকাশ করে দেবপ্রিয় বলেন, আনুতোষিক ব্যয়ে ৭৫ লাখ টাকা সুবিধা দেয়া হয়েছে। সেটা উচ্চবিত্তের মানুষরা পাবেন। এটা আমাদের কাছে বৈষম্যপূর্ণ মনে হয়েছে। যখন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে সুবিধা দিলাম না, কিন্তু উচ্চবিত্তকে আনুতোষিক ব্যয়ে সুবিধা দিচ্ছি, এটা অর্থনীতির সাম্যনীতিতে ঠিক হলো না।
দেবপ্রিয় বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করাও কঠিন হবে। রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য পূরণ না হলে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করলেও সরকারকে অধিক সুদে সঞ্চয়পত্রের ঋণে ঝুঁকতে হবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয়। সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ কমিয়ে ব্যাংকিং খাতকে চাঙ্গা করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা লক্ষ্য করছি না।
বাজেটে করপোরেট ট্যাক্স কমানোর বিরোধিতা করে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংক খাতে যে ধরনের নৈরাজ্য চলছে, সেটা সমাধান না করে এ ধরনের সুবিধা দেয়া আগে যেভাবে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সেটাকে ধরে রাখা হয়েছে। এর ফলে তারল্য বাড়বে না বলেই আমাদের সন্দেহ।
বাজেটে কোনো নতুনত্ব নেই বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়। তার মতে, চলতি অর্থবছর যা ছিল আগামী অর্থবছরেও তাই রয়েছে। তাই এক কথায় এ বাজেটকে স্থিতাবস্থার বাজেট বলে অভিহিত করা যায়। রোহিঙ্গাদের জন্য কী পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে সেরকম কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়নি বলেও সমালোচনা করেন দেবপ্রিয়।
নির্বাচনী বাজেট কি না প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, এটা রাজনৈতিক অর্থনীতির বাজেট। এতে যারা বাজেটে অর্থায়নের সহযোগিতা করবে তাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বাজেটে জনতুষ্টির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও ভাতা বাড়ানো হয়েছে। আবার অনেক ছোট ছোট প্রকল্প আছে যেগুলোকে জনতুষ্টিমূলক বলা যেতে পারে। তিনি বলেন, করমুক্ত আয়সীমা মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় হিসাব করে বিবেচনা করা দরকার। সাধারণ বা গরিব মানুষ যেটা খায় সেটাতে সুবিধা দেয়া হয়েছে এটাকে আমরা ঠিক মনে করি। যে জায়গাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা হলো, ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে আগে ১,১০০ বর্গফুটে কর দিতে হতো দেড় শতাংশ; ১,১০০ থেকে ১,৬০০ বর্গফুটে ছিল আড়াই শতাংশ- এখন দুটোতেই দুই শতাংশ হারে কর দিতে হবে। ফলে যিনি ছোট ফ্ল্যাট কিনছেন তার ওপর চাপ পড়লো। আমরা বারবার বলছি চাপগুলো কিন্তু, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত অথবা বিকাশমান মধ্যবিত্তের উপর পড়ছে। তবে, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়িত হলে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কেননা সরকার এই লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
বাজেট পর্যালোচনায় সিপিডি জানায়, এখন দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার ৬০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। এতে সরকারের টেকসই ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা বিনষ্ট হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হবে। সঞ্চয়পত্রের ঋণের জন্যও সরকারকে ১৩ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হবে। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিতে, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করতে গেলেও তারল্য সংকট দেখা দেবে। বিষয়টি সরকারের জন্য অনেকটা শাখের করাতের মতোই বলে মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ১৫ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের জন্য ৪৫ শতাংশ। আর বাকি ৫৫ শতাংশ অন্য ২২ মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের জন্য। এই পরিমাণ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি।
এতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ২২ হাজার কোটি টাকা পুঁজি হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই পুঁজি কোথায় বিনিয়োগ করা হবে তা পরিষ্কার করা হয়নি। সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করা হবে।
শিক্ষাখাতে জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয়ের সমালোচনা করে বলা হয়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেই ৭.৮ শতাংশ বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে উন্নত প্রতিযোগিতামূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলা দুরূহ হবে। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের হার মাত্র ১ শতাংশ। যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনের সমাপ্তি টানার আগে ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘বাজেট পরিকল্পনা’ জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। একইসঙ্গে বাজেটের অর্থ খরচের পর এর একটি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। অর্থ যথাযথ প্রক্রিয়ায় খরচ হলো কি না সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত অর্থবছরের বাজেট ছিল চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা।