ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতি ও সাংবাদিকতা

0
703

কৌশিক দে:
জীবিকার তাগিদে হোক আর ইচ্ছে-অনিচ্ছায় হোক উপলক্ষ ছাড়া এখন আর প্রিয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়না। আর যাওয়া হলেও মাত্র ১/২দিন সময় কিভাবে পার হয়ে যায় বলা মুশকিল। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে অনেক সময় কাছের বন্ধুদের সাথেও বছরের পর দেখা হয়না। ছেলেবেলায় এসব বন্ধুদের সাথে একদিন দেখা হলে মনে হতো পেটের ভাত হজম হয়নি;কী যে একটা সমস্যা হয়েছে। সবমিলিয়ে এখন এটিই বাস্তবতা। আমাদের যাপিত জীবন এখন অনেকটাই যান্ত্রিক। যন্ত্রের যেমন যন্ত্রণার শেষ নেই, তেমনি যান্ত্রিক জীবনেরও যন্ত্রণার শেষ নেই। এমনই এক যন্ত্রণার নাম সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা।
এখন চলছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বছর। আগামীতে আসছে জাতীয় নির্বাচন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্ধারিত মেয়াদ শেষেই নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সে হিসেবে চলতি বছরের ডিসেম্বর বা নতুন বছরের প্রথম দিকে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শুরু করেছিলাম গ্রামের বাড়িতে অনিয়মিত যাওয়ার কথা দিয়ে। আবার সেখানেই যেতে চাই। এখন বাড়িতে গেলেই সাধারণ মানুষের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আগামী নির্বাচনে কী হবে; দেশের অবস্থা কী হবে। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জে; সেখানে আওয়ামী লীগের পাল্লা ভারী। আর ভারী থাকার অনেক কারণের মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ ছাড়া ওই অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ হয়না। এছাড়া এটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূণ্যভূমি। খোদ সেখানেও আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উকণ্ঠা তাই স্বাভাবিক বলা যাবেনা। বিশেষ করে আমার জন্মস্থান কোটালীপাড়ায় কয়েকটি এলাকা বরাবরই হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে রয়েছে। তারপরও নির্বাচন এলে তাদের উৎকন্ঠা বেড়ে যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের উৎকণ্ঠার কারণ বুঝতে চেষ্টা করি। তারা অনেকেই বলেন, এদেশে নির্বাচন এলেই সমস্যা। প্রথমেই নির্বাচন ঘিরে ধর্মগত একটি বিভেদ সৃষ্টি করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সে বিভেদ প্রকট আকার ধারণ করলে এ অঞ্চলেও তার আঁচ পড়ে। তাই আওয়ামী লীগের হার-জিত বা ধর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্মীয় রাজনীতির উত্থাণ তাদের উৎকণ্ঠিত করে।
আমার ব্যক্তিগত কর্মস্থল খুলনা। নিজ জন্মস্থানের থেকে জীবনের বেশী সময় এখানে অতিবাহিত করছি। ২০০০ সাল থেকে এ অঞ্চলের প্রতিটি নির্বাচনে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এরমধ্যে জাতীয়, সিটি কপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ কোন নির্বাচনই বাদ যায়নি। এই দীর্ঘ সময়ে রাজনীতির নানা পট পরিবর্তন দেখেছি। ২০০১ সালে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও সে খবর প্রকাশ পেয়েছে। শুধু ২০০১ সালই নয়, রাজনীতি কেন্দ্রীয় তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে প্রায়শই নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা, ভাঙচুর ও সর্বপরি বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। তবে ধর্ম, সাম্প্রদায়িতা, রাজনীতি ও সংঘাত শুধুমাত্র আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। এছাড়া একটি ছোট বিষয়ও নয়।
‘ধর্ম’ বাংলায় মাত্র দুটি শব্দের হলেও এর ব্যপ্তি কোন অংশেই কম নয়। যে, যে ধর্মেরই হোক না কেন। কোন ধর্মই মানুষকে বিপদগামী, হিংসাত্মক হতে অনুপ্রাণিত করে বলে আমার মনে হয়না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এই ধর্মের দোহাই দিয়েই এক শ্রেণির মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের মতো অমানবিক কর্মকান্ডের দিকে নিরিহ মানুষকে ঠেলে দেয়। এখানে বলা রাখা ভাল সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ শুধু বিশেষ কোন ধর্মকে ইঙ্গিত করেনা, এটি সকল ক্ষেত্রেই এক ও অভিন্ন। কেউ যদি মন্দির ভাঙেন, সেটি যেমন জঙ্গি কর্মকান্ড, তেমনি মসজিদ, গীর্জা, পোগোডা বা অন্য কোন উপাসনালয়ের উপর আঘাতকারীরাও একই দোষে দুষ্ট। পরিস্কার করে বললে অপরাধীদের কোন ধর্ম নেই, এটাই বাস্তবতা।
একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা শুধু একটি বিশেষ কারণে সংগঠিত হয়না। বৈশ্বিক ও রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ লুণ্ঠন, রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীকে প্রাধান্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া, কালোটাকার দৌরাত্ম, শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যতা, ক্ষমতার অপব্যবহার হানাহানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে একটি মহল দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় সামিল হতে দেননা। তারা এ গোষ্ঠীকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন রেখে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চান। ফলে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তাদের বিপথগামীতার পথে ঠেলে দেন।
অপরদিকে আমাদের দেশের কিছু কিছু সংবাদ বা গণমাধ্যমও অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় অসহিংষ্ণুতাকে কৌশলে উসকে দেন। ধরা যাক বাংলাদেশে কোন একটি স্থানে খ্রিস্টান বা হিন্দু ধর্মের এক ব্যক্তির ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগেছে; সংবাদ মাধ্যম লিখে দিল, ‘সংখ্যালঘু’ দোকানে আগুন!’ যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু সামাজিক ভাবেই নয়, আমাদের সংবিধানে এমন শব্দ গ্রহণযোগ্য নয় বলে আমার মনে হয়। আবার নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী ঘটনাগুলোও অনেক সময় জটিল থেকে জটিলতর করে তোলা হয়। শুধু নির্বাচন বলবো কেন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে মাঝে মধ্যে উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়।
মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে একজন মানুষ শুধুই মানুষ। তাই সকল ধর্মেই মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণার কারণেই বিপথগামীতায় ধাবিত হই। যা দেশ ও জাতির উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বিনষ্ট করে। নিজের মত প্রকাশের পাশাপাশি অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন কোনভাবেই আমাদের ছোট করবে বলে মনে হয়না। একজন মানুষ হিসেবে এ সত্যকে উপলব্ধী করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ, খুলনা ব্যুরো।