দাকোপে ফসলের পোকা দমনে জনপ্রিয় ‘পার্চিং পদ্ধতি’

0
951

আজিজুর রহমান, দাকোপ থেকে :
খুলনার দাকোপ উপজেলায় আমনখেতের সুরক্ষায় পার্চিং পদ্ধতির ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। ফসলের জমিতে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে এটা প্রাকৃতিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতির নাম ‘পার্চিং’ অর্থাৎ পাখির বসার জন্য দাঁড়। এই উপজেলার ২৮টি ব্লকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় কৃষকেরা পার্চিং ব্যবহার করছে। ধানের চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যে ফসলের জমিতে পার্চিং করা হয়। ইতোমধ্যে এই প্রযুক্তি কৃষকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।

পশ্চিম বাজুয়া গ্রামের আমন খেতে গিয়ে দেখা গেছে, ফসলের জমির মধ্যে কিছূ দূর পরপর কৃষক বাঁশের আগা, কঞ্চি, গাছের ডাল প্রভৃতি পুঁতে দিয়েছেন। অনেকে এখনো ডাল পুঁতছেন। অনেক খেতে আলের পাশে এবং জমির মাঝখানে ধঞ্চে লাগানো হয়েছে। এসব পার্চিংয়ে ফিঙে, শালিক প্রভৃতি পাখি বসে থাকতেও দেখা যায়। পাখি বাঁশের এই আগা, কঞ্চি, গাছের ডালে বসে ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় বিশেষ করে মাজরা পোকা দমনে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর। অনেক জমিতে মাঝেমধ্যে লাগিয়েছেন ধঞ্চেগাছ। এতে কৃষকেরা উপকার পাচ্ছেন। কীটনাশক কম লাগায় কৃষকরা ভীষণ খুশি।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পার্চিং মানে খেতে ডালপালা পুঁতে দেওয়া। ফসলের জমিতে ডাল, কঞ্চি, বাঁশের খুঁটি এগুলো পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করলে পাখি ক্ষতিকারক পোকার মথ, বাচ্চা, ডিম খেয়ে পোকা দমন করে। মূলত ফিঙে, শালিক, বুলবুলি, শ্যামা, দোয়েল, সাত ভায়রা-এসব পাখি পার্চিংয়ে বসে পোকা ধরে খায়। ফসলের পোকা দমনের এ পদ্ধতি বলতে গেলে ব্যয়বিহীন ও পরিবেশবান্ধব। ফসলের খেতে ডেড পার্চিং ও লাইভ পার্চিং দুটিই করা যায়। মরা ডালপালা পুঁতে দিলে তা হবে ডেড পার্চিং। আর ধঞ্চে, অড়হর-এসব জীবন্ত গাছ জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগিয়ে দেওয়া হলো লাইভ পার্চিং। প্রতি শতকে অন্তত একটি বাঁশের আগা, কঞ্চি বা ডাল পুঁততে হয়। ফসল রোপণের পরপরই পার্চিং স্থাপন করতে হয়। ফসলের সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে কমপক্ষে এক ফুট উচ্চতায় পার্চিং করা উচিত বলে তাঁরা জানান।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে, পার্চিং পদ্ধতি কৃষকদের মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। গত মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ১৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করা হয়েছিল। আবাদের ৮০ শতাংশ জমিতে পার্চিং করা হয়েছিল। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এ বছর দাকোপে ১৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট আবাদের ৮৩ শতাংশ পার্চিং করা হয়। এখনো ২৮টি ব্লকের আমনখেতে পার্চিং চলছে। চলতি বছর তা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত হবে বলে আশা করা যায়।

উপজেলার পানখালি ব্লকের কৃষক সাগর হালদার এবার ছয় বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন। তিনি সম্পূর্ণ খেতে পার্চিং করেছেন। তিনি বলেন, ছয় বিঘা জমির আমন ধানখেতে তিনি গাছের ৩০টি ছোট ডাল ও বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দিয়েছেন। ফিঙে ও শালিক ওই ডালে বসে খেতের ক্ষতিকর পোকা, বিশেষ করে মাজরা পোকার মথ ধরে খেয়ে ফেলছে। এতে ভালো কাজ হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহার অনেক কমেছে।

পোকামাকড়ের হাত থেকে ধানের গাছ রক্ষা করতে চারা লাগানোর মাসখানেকের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধানে গাছের ডাল ও কঞ্চি পুঁতে রেখেছেন বাজুয়া গ্রামের কৃষক ফণী ভূষণ মণ্ডল। এ বছর তিনি ১৫ বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ৪৮টি ডাল ও ৪২টি কঞ্চি পুঁতেছি। এতে ফিঙে ও শালিক পাখি এসে বসে। পাখিগুলো ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। অন্যবার যেখানে তাঁকে তিন থেকে চার দফা কীটনাশক ব্যবহার করতে হতো, এ বছর মাত্র একবার কীটনাশক ব্যবহার করেছেন।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ২০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, বেশির ভাগ কৃষক পাখি বসার উপযোগী বাঁশের আগা, কঞ্চি, গাছের ডাল প্রভৃতি পুঁতে আমন খেতে ক্ষতিকর পোকা দমন করছেন। অনেক জমিতে মাঝেমধ্যে লাগিয়েছেন ধঞ্চেগাছ। এতে কৃষকেরা উপকার পাচ্ছেন। কীটনাশক কম লাগায় কৃষকেরা খুশি। এ ছাড়া রাতে পার্চিংয়ে পেঁচা বসে খেতের ইঁদুর ধরছে। আলের ওপর প্রায় প্রতিদিনই পেঁচায় খাওয়া ইঁদুরের মাথা পাওয়া যাচ্ছে। ইঁদুর দমনে পার্চিং ব্যাপক কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন কৃষকরা।

দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান খুলনাটাইমসকে বলেন, আগে চাষিরা ধান লাগানোর পর বিলের মধ্যে গিয়ে পার্চিং করতে চাইতেন না। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে কৃষক সহজেই তাঁর জমিতে পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব পার্চিং পদ্ধতি করে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদ করতে পারছেন। এই পদ্ধতি কৃষকদের উপকারে আসছে, খরচ বাঁচাচ্ছে বলে পার্চিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, আগে কৃষক ডেড পার্চিং বেশি করতেন। এখন লাইভ পার্চিংয়েও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ বছর এখনো আমন খেতে পার্চিং চলছে। তবে শতভাগ পার্চিংয়ের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে প্রায় ৮৩ শতাংশ আমন খেতে পার্চিং হয়ে গেছে।