দক্ষিনাঞ্চলে পাট শিল্পের ন্যায় চিংড়ি রপ্তানী শিল্পেও ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত ঋণ ঝুঁকিতে

0
816

ফকির শহিদুল ইসলাম 
খুলনাসহ দেশের দক্ষিনাঞ্চলে পাট ব্যবসায়ীদের দেয়া ব্যাংকঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে গেছে। নতুন করে খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানী শিল্প। এছাড়া চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায়, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলো নামমাত্র উৎপাদন করায় ব্যাংকের ঋণ খেলাপী হয়ে পড়েছে রপ্তানীকারকরা । খুলনাঞ্চলে বর্তমানে চিংড়ি রফতানিকারক অর্ধেক প্রতিষ্ঠান নানাবিধ কারণে দিনকে দিন রুগ্ন হয়ে পড়েছে। ফলে চিংড়ি উৎপাদনে মৎস্য চাষী ও রপ্তানী শিল্পের সাথে জরিতদের কর্মসংস্থান সীমিত হয়ে পড়ছে । অধিকাংশ চিংড়ি রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের ঋণ খেলাপী হওয়ায় কারনে এ শিল্পে নিয়োজিত বিপুল সংক্ষক শ্রমিক,কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হচ্ছে ।এ অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানী শিল্পে বিনিয়োগকৃত ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপিঋণে পরিনত হয়েছে । এ কারণে নতুন করে চিংড়ি রপ্তানী শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী নন ব্যাংকগুলো।

চিংড়ি রপ্তানী শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ‘হোয়াইট গোল্ড’খ্যাত বাংলাদেশের চিংড়ির আগের মতো কদর নেই। ভোক্তা দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা ও অন্য দেশের চিংড়ির তুলনায় বাংলাদেশের চিংড়ির মূল্য বেশি হওয়ায় রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এছাড়া চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্য রফতানি খাতে কিছু ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীও গড়ে উঠেছেন।

ব্যাংকাররা বলছেন, চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্য উৎপাদন ও রফতানির নাম দিয়ে কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। নানা অজুহাতে এ ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা আর ফেরত দেননি। ফলে খুলনা অঞ্চলে হিমায়িত খাদ্যে ব্যাংকঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। নতুন করে এ খাতে ঋণ দেয়ার বিষয়ে ব্যাংকাররাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক।

সূত্রমতে, খুলনা অঞ্চলে চিংড়িসহ হি মায়িত খাদ্যে ব্যাংকগুলোর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। এর বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির সাতক্ষীরার শ্যামনগর শাখার গ্রাহক মেসার্স পেঙ্গুইন আইস অ্যান্ড ফিশ প্রসেসিং লিমিটেডের কাছে ঋণ রয়েছে সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে খেলাপি থাকার পর ২০১৬ সালে ঋণটি অবলোপন করেছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির সাতক্ষীরা শাখার গ্রাহক মেসার্স সুন্দরবন ফিশ প্রসেসিংয়ের কাছে ঋণ রয়েছে ১৮ কোটি টাকার। মন্দ মানের খেলাপি হওয়ায় এ ঋণও অবলোপন করেছে অগ্রণী ব্যাংক। একইভাবে অগ্রণী ব্যাংক খুলনা স্যার ইকবাল রোড করপোরেট শাখার গ্রাহক ডিআরটিসি ফিশ ফ্রিজিংয়ের ১১ কোটি ও বেঙ্গল ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির ৬ কোটি টাকা অবলোপন করতে হয়েছে।

চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্যে বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকও। ব্যাংকটির খুলনা অঞ্চলের শাখাগুলো থেকে খাতটিতে দেয়া ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। সোনালী ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স এশিয়ান সি ফুড লিমিটেডের কাছে ব্যাংকটির ঋণ রয়েছে ৫২ কোটি টাকা। এ ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. আজিজুর রহমানের নামে মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক। একইভাবে ব্যাংকটির মেসার্স বাগেরহাট সি ফুড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের কাছে ২২ কোটি, মেসার্স লখপুর ফিশ প্রসেসিং কোম্পানি লিমিটেডের কাছে ১৯ কোটি, শম্পা আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের কাছে ১০ কোটি, মেসার্স বাংলাদেশ সি ফুড লিমিটেডের কাছে ২৩ কোটি, মেসার্স এশিয়ান সি ফুডস লিমিটেডের কাছে ৫৩ কোটি ও মেসার্স স্টার সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে ২৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্যে দেয়া ঋণের প্রায় পুরোটাই খেলাপি বলে জানান রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান তিনি বলেন, খুলনা অঞ্চলে চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্য ব্যবসায়ীদের ঋণ নিয়মিত রাখা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে উদ্বেগ আছে। নতুন করে খাতটিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। ভালো ব্যবসায়ী ছাড়া এ খাতে নতুন করে অর্থায়ন করার ইচ্ছা আমাদের নেই।

খুলনা অঞ্চলের প্রান্তিক চিংড়িচাষীরা বলছেন, চিংড়ি চাষ করে এখন খামারিদের সেভাবে মুনাফা হচ্ছে না। তার পরও চিংড়ি চাষ থেকে তারা বের হতে পারছেন না। কারণ আশির দশক থেকেই সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ খুলনা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিকে চিংড়িঘেরে রূপান্তর করা হয়েছে। ওই সময় দ্বিগুণ মুনাফার আশায় কৃষকরাও বুঝে না বুঝে ফসলের জমিতে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়েছেন। কিন্তু ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়িই এখন তাদের দুরবস্থার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের সবচেয়ে বেশি চিংড়ি উৎপাদন হয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে। ওই এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন গাজী বলেন, বাপ-দাদার প্রায় ৩০ বিঘা ফসলি জমিকে চিংড়িঘেরে পরিণত করেছিলাম। ২০ বছর আগে এ পরিমাণ জমিতে যে মূল্যমানের ফসল উৎপাদন হতো, বর্তমানে তার অর্ধেক দামের চিংড়িও উৎপাদন হচ্ছে না। ঘেরের চিংড়ির বড় অংশই মরে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই চিংড়ির মড়ক মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। চতুর্দিকে ঘের পরিবেষ্টিত হওয়ায় চিংড়ি থেকে ফসলে ফেরারও কোনো উপায় নেই।

ফসলি জমি ও চিংড়ি খাত দুটিকেই বাঁচিয়ে রাখতে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম জহির বলেন, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলাশয় ও অনাবাদি জমি খালি পড়ে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এসব ভূমিকে চিংড়ি চাষের উপযোগী করতে পারলে দেশে চিংড়িসহ মাছ উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব হতো। এতে ফসলের জমি যেমন রক্ষা পেত, একইভাবে কৃষকরাও উপকৃত হতেন।

চিংড়িসহ হিমায়িত খাদ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগকে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, খুলনা অঞ্চলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। খুলনার পাট শিল্পের মতোই চিংড়িতেও ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে। এ দুটি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকাররা আগের তুলনায় অনেক বেশি সতর্ক। ভালো ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এ দুই খাতে অনেক মন্দ ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটেছে। জেলি কিংবা লোহা পুশ করে এ ব্যবসায়ীরা চিংড়ি রফতানি করেছেন। ফলে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অনৈতিকতার চর্চাও ভূমিকা রেখেছে।