দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তির কল্যানে

0
390

ফকির শহিদুল ইসলাম:
কৃষিজমির বহুমুখী ব্যবহারে বদলে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কৃষকদের ভাগ্য । গত কয়েক বছরে উপকূলীয় জেলা পিরোজপুর খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে এবং গোপলগঞ্জ, বৃহত্তর যশোরের নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গ, মেহেরপুর জেলার কৃষি উন্নয়নের চিত্র পাল্টে গিয়েছে। এ অঞ্চলে সরকারের বিভিন নতুন নতুন কৃষি প্রকল্পের ফলে বদলে যাচ্ছে কৃষির সার্ভিক দৃশ্যপট। দক্ষিণাঞ্চলে কৃষির উন্নয়নে রয়েছে স্বল্প ও দির্ঘ মেয়াদের কয়েকটি কৃষিপ্রকল্প । গৃহীত এসব প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি গবেষন ামুলক কর্মকান্ড, মাটির পরীক্ষা পূর্বক ফসল লাগানো ও আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকরনের আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রে। ব্যাপক কর্ম সংস্থানের সৃষ্টির ফলে সম্ভব হয়েছে দারিদ্র বিমোচন।
কৃষি মন্ত্রনালয়ের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গোপালগঞ্জ জেলার বিএআরআইবি এর কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন প্রকল্প,মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, বাংলাদেশে শাকসবজি, ফল ও পান ফসলের পোকা মাকড় ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশক ভিত্তিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প (বারি), গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষিরা ও পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (ডিএইঅংগ), বৃহত্তর খুলনা ও যশোর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প, লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প,কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ন্যশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রোগ্রাম -২য় পর্যায় (এনএটিপি-২), আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের ধান, গম ও পাট বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বিলুপ্ত প্রায় ও পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য তাল, খেঁজুর, সুপারি ও নিম চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প । গৃহিত এ সকল প্রকল্পের প্রশিক্ষন, বিনামুল্যে সার, বীজ, মাঠ দিবস, নতুন প্রযুক্তি ,সঠিক সময়ে সঠিক জাতের উন্নত মানের ধান, গম ও নিত্য নতুন বীজ সহজ লভ্য করে ফসলের উৎপাদন শীলতা বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র সেচ ব্যাবস্থপনার আওতায় মরা খাল খনন, গভীর নলকুপ দ্বারা পানি সরবরাহ করার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন শীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে । কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে সরকার বিনামূল্যে মানসম্মত সিজন ও অফ সিজনের ফলজ বীজ সরবরাহ, ধান, গম ও পাট বীজ চাষী পর্যায়ে উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে কৃষকের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ভুমিকায় রেখেছে। কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃষকের বীজের চাহিদা পূরণ, মাটি পরিক্ষা, উন্নত মানের বীজ ব্যবস্থাপনা, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি হস্তান্তর, কৃষি প্রনোদনা, মাঠ পর্যায়ে কৃষক জরিপ, কৃষকে কার্ড প্রদান এবং মাঠ পর্যায়ের কৃষক ও কৃষি বৈজ্ঞানিক, কৃষি কর্মকর্তা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সম্পর্ক জোরদার এবং দ্রুত চাষী পর্যায়ে এলাকা ভিত্তিক নতুন জাত সম্প্রসারণ করা ও মানসম্মত বীজ উৎপাদনের পাশাপাশী কৃষি প্রশিক্ষন, কৃষি প্রদর্শনী প্লট হস্তান্তর, কৃষক মাঠ দিবস, কৃষি মেলা, ও কৃষকের উৎপাদিত পন্য বিপণনের মাধ্যমে কৃষক দের গ্রামীন এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীন দারিদ্র কৃষক ও নরনারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে মাঠে কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে নিবির সম্পর্কের ফলে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ধান ও সবজির উৎপাদনের পাশাপাশী প্রায় ২৭ ধরনের গ্রীষ্মকালীন ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। এর উপকার পাচ্ছেন ১০/১২ টি জেলার কয়েক লক্ষ কৃষক ও তাদের পরিবার। উপকুলীয় ও অন্যান্য পার্শবর্তী জেলার অব্যবহৃত জমি ও বসতবাড়ীর চারপাশের জমিকে আধুনিকপ দ্ধতিতে চাষাবাদের আওতায় উদ্যান ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে । কৃষকরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ফসল বাজারে বিক্রিয় করতে পারছেন। এছাড়াও লবণাক্ত এলাকার ঘেরের আইলে অফ সিজনে তরমুজ দুইবার চাষাবাদ করে অনেকের অর্থনৈতিক ভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছ। কৃষি প্রকল্পের কারনে ধান ও বিভিন্ন জাতের সবজির উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। ঘেরের আইলে বা পতিত জমিতে শিম, লাউ, কুমরা বরবটি, ভুট্রা, টমেটো, বাধাকফি, ফুলকফি, সুর্যমূখি, উন্নত মানের ডাল, তেল ও মসলা বীজসহ আগাম সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দুইযুগ আগেও উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় একটিবা দুটি ফসল হতো। তখন বছরের অধিকাংশ সময় কৃষি জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকত। এ অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয় গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় সার্ভে করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। এ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ জেলায় ইউনিয়ন ভিত্তিক মাটির গুণাগুণ যাচাই, সার প্রয়োগ ও চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে। এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণ াইনস্টিটিউটের নতুন নতুন ফসল এবং ফলের জাত উদ্ভাবনের ফলে ধানসহি বভিন্ন ফল ও সবজি চাষে উৎসাহিত হচ্ছে। একই সঙ্গে চাষির জমিতে প্রদর্শনী প্লট তৈরি করে ঘেরের পাড়ে পতিত জমিতে আগাম সবজি চাষে উৎসাহিত করায় এ পরিবর্তন শুরু হয়।
গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি ও লবণা ক্ততার কারণে প্রায় ছয় মাস জমি ফসল হীন থাকে। ওই জমিকে কাজে লাগাতে লবণ, খরা ও দুর্যোগ সহনীয় ভুট্টার আবাদ করে সফল হয়েছে। এরই মধ্যে বটিয়া ঘাটার লবণাক্ত জমিতে ভুট্টাচাষ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। খুলনার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা ও গোপালগঞ্জে প্রথম বারের মতো বর্ষাকালীন তরমুজের চাষ করা হয়েছে। অসময়ের এ তরমুজ উৎপাদনে চাষিরা ভালো দাম পেয়ে তারা একবার তরমুজ উৎপাদন করে বিক্রি করে পূনরায় আবার একই জায়গায় বর্ষা কালীন দ্বিতীয় তরমুজের চাষ করছে। এ ছাড়া মাল্টিলেয়ার পদ্ধতিতে একই জমিতে একই সঙ্গে একাধিক ফসল আবাদে প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, যাতে সারা বছরই মাঠে ফসল থাকে এবং পর্যায় ক্রমে চাষিরা তা বিক্রি করতে পারেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, খুলনা জেলায় প্রায় ৯২ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে আমন ধান, সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন ও ৬ হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে শীত কালীন সবজির চাষ হয়। তবে চলতি বছরে জমিতে ধান ও আগাম সবজি চাষে বিপ্লব ঘটেছে বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার আবু উবাইয়াবলেন, ‘বাজারে এখন শীতকালীন সব ধরনের সবজি পাওয়া যায়। কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারে এ বছরপ্রায় ১২৩ হেক্টর পতিত জমিতে বর্ষাকালীন তরমুজ চাষ হয়েছে। ঐ জমিতে একই সঙ্গে শিম, বরবটি, লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স চাষেও নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এদিকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষককে উচ্চ মূল্যের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে ।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণ াইনস্টিটিউট খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানি ককর্মকর্তা ও দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী গবেষণ াকার্যক্রম জোরদার করনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক ড. হারুনর রশিদ বলেন, বর্তমান সরকার কৃষি ও কৃষক বান্ধব সরকার । সরকার উপকুলীয় অঞ্চলের কৃষকের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গোপালগঞ্জ জেলার বিএআরআইবি এর কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল পরিবেশ প্রতিবেশ উপযোগী গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করনের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে মিশ্র ফলের বাগান করতে কৃষককে সহায়তা করা হচ্ছে। কৃষককে মিশ্র ফলের বাগান তৈরিতে উন্নত ফলের চারা, বেড়া সরঞ্জাম, সার, কীটনাশক দিয়েছেন এবং খেত তৈরীতে নগদ অর্থ ও চারা রোপনের প্রশিক্ষণ দেয়া কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আমাদের বৈজ্ঞানিকরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছে এ অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে । উদ্ভাবিত কার্যকরী প্রযুক্তি সমূহ মাঠ পর্যায়ে দ্রুত জনপ্রিয় করতে প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের প্রদর্শনী প্লট হস্তান্তর। এ ছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সার্বিক সহযোগিতায় উচ্চ ফলনশীল জাত সমূহের উপযোগিতা যাচাইয়ের পর পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপযোগী সবজি, ফল, ডাল, আলু, তৈলবীজ, গম, ভুট্টা, সুর্যমূখি, নারিকেল, তালএবং খেজুরের প্রযুক্তি সম্প্রসারণে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষে কৃষক প্রশিক্ষণ ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধির ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপ ককর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশী দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হচ্ছে ।

খুলনার উপপরিচালক হাসান ওয়ারিসুল কবীর বলেন, আগে যেখানে লাউ, কুমড়া বিক্রি করে চাষি উৎপাদন ব্যয় উঠাতেন এখন সেখানে ঘেরের ওপর মাচায় তরমুজ চাষে বহুগুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ যোগাযোগ ও বাজার অবকাঠামো উন্নয়নে চাষিদের জন্য কৃষি সহায়ক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির পাশাপাশি বদলাচ্ছে কৃষকের ভাগ্য।