ত্রাণ নয়, নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত কয়রাবাসী চায় স্থায়ী সমাধান

0
706

ওবায়দুর কবির সম্রাট, কয়রা:
খুলনার কয়রার উপকূলীয় মানুষের যাপিত জীবনের মূল সমস্যাই হচ্ছে নদী ভাঙ্গন। আচমকা পানি বাড়লে বা বন্যা শুরু হলে নদী বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। নদী ভাঙ্গন মানুষের জীবনকে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে ফেলে দেয়। ভাঙ্গন মানেই উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র অসহায় মানুষের তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার, ঘরবাড়ি এবং সহায় সম্বল তছনছ হয়ে যাওয়া। চোখের পলকেই সব নদী গর্ভে চলে যাওয়া। উঠানের চুলো থেকে শুরু করে বাড়ির ঘটি-বাটি কিছুই থাকে না। অনেকে তড়িঘড়ি কিছু রক্ষা করতে পারলেও অনেকেই আবার পারে না। অর্থাৎ নদীভাঙ্গা পরিবারগুলোকে এক বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের সুপার সাইক্লোন ঘূর্নিঝড় আম্পানে নদী ভাংঙ্গনে প্রায় ১৩ হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। কয়রায় কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ১৩ টি পয়েন্টে নদী ভাংঙ্গনে উপজেলার ৩০টি গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার এখন নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর তীরবর্তী ৪টি ইউনিয়নে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবতার জীবনযাপন করছেন। প্লাবিত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গবাদী পশুর খাদ্য নিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন পানিবন্দী মানুষ। উপজেলার কয়রা, মহারাজপুর, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ আছে, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। পানিতে তলিয়ে আছে, উপজেলা সদর রাস্তা ঘাট ও গোটা উপজেলা চত্বর। গ্রামের অনেক বাসিন্দারা ঘরের মধ্যে বাঁশের উচু মাঁচা তৈরি করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে গবাদী পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পরিবারগুলো। গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির চরম সঙ্কটে পড়েছে গ্রামবাসী।
বর্তমানে ভাঙ্গন তীব্রতা ভয়াবহ আকার ধারণ করায় নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এদের কেউ আত্মীয়স্বজন ও কেউবা রাস্তার পাশে নিরাপদ স্থানে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় কোনো আশ্রায়কেন্দ্র না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে শত শত পরিবার।
কয়রা উপজেলার, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, লোকা, সদর ইউনিয়নের গোবরা হরিণ খোলা, গোবরা ঘাটাখালি, ২ নং কয়রা খালের গোড়া ৩ কিলোমিটার ওয়াবদার রাস্তা সম্পূর্ণ বিলিন হয়েছে, উত্তর বেদকাশি গাজি পাড়া, রত্না ঘেরি, কাশিরহাটখোলা, দক্ষিণ বেদকাশি গোলাখালি, আংটিহা, ছোট আংটিহারা বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে গোলা এলাকা সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে পানির নিচে আছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ সরিয়ে নিচ্ছে তাদের বসতঘর, মূল্যবান গাছপালা কেটে ফেলছে। এছাড়া কপোতাক্ষ ও শাকবাড়গিয়া নদীর ভাঙ্গন আজও ছাড়ছেনা, কয়রা উপজেলার মানুষের সব সময় থাকতে হয় বেড়িবাধ ভাঙ্গনের আতঙ্কে উপজেলার বাসিন্দাদের। নিরবে ভেঙ্গেই চলছে শত বছরের পুরানো স্থাপনা। প্রতি বছরই বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে প্রধানমন্ত্রী জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আহবান জানান।
জানা যায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের শুরু থেকে এলাকাই অবস্থা করে জনগণের খোজ খবর ও বন্যা কবলিত নিজ এলাকা পরিদর্শন করেন, সাহায্য ও খাদ্য সামগ্রী ও বিতরণ করছে। এছাড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস যোগান। স্থানীয় সংসদ, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা উর্দ্ধতন কতৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সাথে টেকসই বাধের ব্যাপারে বারবারই কথা বলেন। কিন্তু কাজের কাজ যেটা করতে হবে (টেকসই বেড়িবাধ) তার ধার কেউই দারে না। কয়রার নদী ভাঙ্গন এটা নতুন কোন ইসু নয়। এ বছর ভাঙ্গছে এমনও নয়। প্রতি বছর কম বেশি কয়রায় নদী ভাঙ্গনের বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। কিন্তু নদীভাঙন প্রতিরোধের জন্য আজো কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারি-বেসরকারি ভাবে যে সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হয় তা অতি সামান্য, একটা পরিবার সাহায্যের অর্থ দিয়ে বড়জোড় ২/৪ দিন চলতে পারে।
নদীভাঙ্গনে নি:স্ব হওয়া আবুল কালাম বলেন, এই সামান্ন সাহায্য দিয়ে কি হবে। প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গনে ভিটে হারা হচ্ছে হাজার হাজার বসত ভিটা। গেল বছর আমার বড় ভাই নি:স্ব হলো এবছর হলাম আমি। জানিনা আগামী বছর আবার কোন ভাই আমার মত নি:স্ব হয়ে যায়। আমরা সাহায্য চাই না। সরকারের কাছে আমাদের দাবী নদী ভাঙ্গন রোধ করুক।
কয়রায় কপোতাক্ষের ভাঙ্গনে ভিটে মাটি হারানো সালমা খাতুন বলেন, আমাদের দু:খের শেষ নেই। আমরা চাই না নতুন করে আর কেউ এই দু:খের সঙ্গী হয়। তাই সরকারের কাছে দাবী নদী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক।
সরকারি-বেসরকারি ভাবে কোন সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়া কুদ্দুস বলেন, আমাদের এখন কেউ নাই, কেউ দ্যাখে না। শুনি সাহায্য-সহযোগিতা আসে, আমি কিচ্ছু পাই নাই। কেউ জিজ্ঞাসও করে না। যখন ইলেকশনের সময়টা হয়, সেই সময় ইলেকশনের ভোটের জন্য পাগল হয়ে যায়। আমরা কিছুই পাই না, খালি নেতারা পায়। চেয়ারম্যান মেম্বরদের লোকের পেট ভরায়, আমাগো আর ভরায় না। “ইলেকশনের সময় আইলে আমাগো কাছে তারা আবার আইবো। এলাকার নেতাপ্যাতা বহুত কিছু বলছে। এখন কারো খবর নাই। নদী ভাঙ্গনে সব চলে গেছে এখন কারো খবর নাই। সরকার যদি না দেখে আমাগো বাচার কোন উপাই নাই।”
সচেতন মহল নদীভাঙন প্রতিরোধে খুব একটা ভালো ও কার্যকর উদ্যোগ এ যাবতকাল গ্রহণ করা হয় না। নদী ভাঙন রোধে কিছু শহর আর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকেই কেবলই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আর এই কাজটি করে থাকে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কোথাও কোথাও প্রকল্প গ্রহণ করা হলেই সেখানে আবার পুকুর চুরির ঘটনা ঘটে। এই চুরি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। অথচ সাধারণ মানুষ বা জীবন জনবসতিকে কীভাবে রক্ষা করা যেতে পারে? সেই উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আর এ কারণেই প্রতিবছর নিঃস্ব-হতে হয়। ভিটে হারানোর কষ্ট আর কান্নায় কেবলই তাদের চোখের পানি নদীর মতো বয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী ভাঙন রোধের প্রধান উপায় হলো টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা। এছাড়া নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা ও খাল গুলো খনন করা। কিন্তু আধুনিক পদ্ধতি নদী ড্রেজিং- ও বাধ নির্মাণ এর কাজ এখনও চোখে পড়ছে না। দেশের নদীগুলো ড্রেজিং ও টেকসই বেড়িবাধ করা না গেলে আগামীতে ছোট খাটো বন্যাও আমাদের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আগামী কয়েক বছরে টেকসই বেঁড়িবাধ করা না হলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে উপকূলী অঞ্চল কয়রা।