“তাদের নিখাদ দেশপ্রেম আর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আমাদের রাজনীতির পুঁজি”

0
245

লেখক: মোঃ নজরুল ইসলাম

১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন ভাগিরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।স্বাধীনতার সেই অস্তমিত লাল সূর্যকে উদিত করার এক অদৃশ্য নেশায় বঙ্গবন্ধুর আহবানে ও নেতৃত্বে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন খুলনার আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম সংগঠক বয়রা,মহম্মদ নগর ইউনিয়নের কয়েকজন কৃতি সন্তান।বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ আব্দুল করিম (করিম চেয়ারম্যান), মির্জা আফজাল হোসেন, শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ, শেখ দবিরুল ইসলাম (দবির চেয়ারম্যান), শেখ আব্দুল গফফার (নেতা গফফার), মোল্লা আবু জাফর (জফা), শেখ আব্দুল ওয়াদুদ, শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ এবং এফ এম মাকসুদুর রহমান তাদের মধ্যে প্রধানতম।প্রয়াত এসব কীর্তিমান পুরুষ এবং এবং ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করা তাদের পরিবারের বীর সদস্যদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে এবং আওয়ামী রাজনীতিতে তাদের অবদান এবং তাদের অবিনাশী সংগ্রামের ইতিহাস ও বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে জানতে হবে,জানতে হবে আজকের নতুন নেতৃত্বকে। কারন স্বাধীনতার উদিত লাল সূর্য, লাল সবুজের আমাদের অস্তিত্বের পতাকা আর আমাদের পরিচয়ের স্বাধীন মানচিত্র তো জাতির পিতার নেতৃত্বে জাতির এই সূর্য সন্তানদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের ফসল।

মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনা শহর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন খুলনার আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম পথিকৃত বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য প্রয়াত জননেতা বয়রার কৃতি সন্তান মির্জা খয়বার হোসেন। বিংশ শতাব্দীর ৩০’র দশকের শেষ মধ্যভাগে খুলনা শহরের বড় বয়রায় সম্ভ্রান্ত মির্জা পরিবারে তার জন্ম। মুসলিম লীগের দূর্ভেদ্য ঘাঁটি খুলনার মাটিতে মুজিব আদর্শকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে অনবদ্য অবদান রাখেন মির্জা খয়বার হোসেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রচার, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান,৭০’র নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে তার রয়েছে অসামান্য অবদান। মির্জা খয়বার হোসেন ছাড়াও ৬ দফার প্রচার, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বয়রা,মহম্মদ নগর এলাকায় শেখ আব্দুল করিম (করিম চেয়ারম্যান), মির্জা আফজাল হোসেন, শেখ দবিরুল ইসলাম (দবির চেয়ারম্যান), শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ (হিসাম মেম্বর), শেখ আব্দুল গফফার (নেতা গফফার) এবং মোল্লা আবু জাফর জফা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২২ শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং এর প্রায় এক মাসের মাথায় ২৫ শে মার্চ লৌহমানব জেনারেল আইয়ুব খানের পতনের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়া জেনারেল ইয়াহিয়া গণতন্ত্রের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক তৎপরতার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ৮ ই ফেব্রুয়ারি খুলনা সার্কিট হাউজ মাঠে খুলনার স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় যোগ দেন। উল্লেখিত নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে বয়রা,মহম্মদ নগর এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগ দেন। তৎকালীন সময়ে খুলনায় আওয়ামীলীগের যে কোনো সভা, সমাবেশ সফল করতে বয়রা ও মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের এসব নেতৃবৃন্দ সবচেয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতেন।বঙ্গবন্ধুর এই জনসভার পর খুলনার সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ অনুপ্রাণিত হন এবং ৭০’র নির্বাচনের জন্য কাজ করা শুরু করে দেন।

খুলনায় আওয়ামীলীগ তখন এতটাই সুসংগঠিত এবং জনপ্রিয় ছিল যে সবুর খানের মত মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী ও ৭০’র ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রার্থী ভাষা সৈনিক এম এ গফুরের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের সরাসরি নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ১৬০ টি আসনে বিজয়ী হয়। ময়মনসিংহের একটি আসন থেকে তৎকালীন মুসলিম লীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রবীণ নেতা পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন জয়ী হন। অন্যদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের একটি আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন। আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ৭ টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের ৭ টিই লাভ করে। ফলে জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ১৬৭ টি আসন লাভ করে সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০ টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ পায় ২৯৮ টি। অর্থাৎ জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামীলীগের পার্লামেন্টারি দলের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পরিষদে পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন এবং ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন।জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। পূর্ব নির্ধারিত ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পহেলা মার্চ স্থগিত করেন।উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৩ রা মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐ ছাত্র সমাবেশ থেকে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক এবং জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৩ রা মার্চ থেকে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত চলে অসহযোগ আন্দোলন, একইসাথে চলে আলোচনা।

সারাদেশের ন্যায় খুলনার রাজপথ ও উত্তাল হয়ে ওঠে। খুলনার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ২ রা মার্চ শহীদ হাদীস পার্কে এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে যারা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মির্জা খয়বার হোসেন।প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়। বিভিন্ন অস্ত্রের দোকান লুট করা হয় অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। বন্দুকের দোকান লুটে নেতৃত্ব দেন সে সময়ের খুলনার প্রথম সারির ছাত্রনেতারা।খুলনা শহর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মির্জা খয়বারের উদ্যোগে ও অর্থায়নে তার বটিয়াঘাটাস্থ পরিত্যক্ত একটি বাড়িকে বোমা বানানোর জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এবং সেখানেই বোমা বানানোর কারখানা গড়ে তোলা হয়। বোমা বানানোর সকল সরঞ্জামাদি সংগ্রহ এবং সরবরাহ করতেন মির্জা খয়বার হোসেন নিজে। ৩ রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পর মার্চ মাসের প্রথমদিকে খুলনা আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বয়রায় শেখ হেসাম উদ্দিন মেম্বরের বাড়ি সংলগ্ন জামরুলতলায় (বর্তমানে যেখানে শেখ আহমদিয়া জামে মসজিদ অবস্থিত) এক আলোচনা সভায় মিলিত হন। এই আলোচনা সভা থেকে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের সমাবেশ বানচালের লক্ষ্যে ৬ ই মার্চ সমাবেশের আগের দিন সকল পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে কুটকৌশলের আশ্রয় নেন জেনারেল ইয়াহিয়া।কিন্তু বঙ্গবন্ধু কুটকৌশলের ফাঁদে পা না দিয়ে সমাবেশ মঞ্চে হাজির হয়ে ঘোষণা করেন সেই ঐতিহাসিক বানী-
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বাঙালির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু
পূর্ব বাংলার জনগণকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার আহবান জানালেন।আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ দিলেন বঙ্গবন্ধু।পুরো পূর্ব পাকিস্তান চলতে লাগল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।পাকিস্তানী শাসকের ভীত কেঁপে উঠল বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের ঘোষণায়।আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করার কৌশল গ্রহণ করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার গ্রীণ সিগন্যাল। এই ঘোষণার পর সারাদেশে মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করলেন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ২১ শে মার্চ খুলনা শহীদ হাদীস পার্কে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উদ্যোগে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশ শেষে মির্জা খয়বার হোসেন, মুনসুর আলি এবং কামরুজ্জামান টুকু সহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। ২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা বাংলায় উড়ানো হল লাল-সবুজের পতাকা। ২৪ শে মার্চ আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করলেন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ আর নয়।২৫ শে মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঢাকা শহর সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো হল নৃশংস গণহত্যা। আওয়ামীলীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাড়িতে আক্রমণ করল হানাদার বাহিনীর বর্বর সদস্যরা। অনেককে আটক করা হল সে রাতে।

বন্দী করা হল ২৩ বছর ধরে বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা বাঙালির অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাত ১ টা ২৫ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি আর্মির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ১২ টা ২০ মিনিটে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা সারাদেশের ন্যায় খুলনাতেও পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা খুলনায় টেলিফোনের মাধ্যমে পাঠানো হয় তৎকালীন শহর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মির্জা খয়বার হোসেনের কাছে। এই ঘোষণা দ্রুত মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার ও নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। মির্জা খয়বার হোসেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তিনি ঐ রাতেই মাইকিং করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা খুলনা শহরের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছে দেন। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃবৃন্দকেও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ঘোষণার’ কথা জানান মির্জা খয়বার হোসেন। উল্লেখ্য তৎকালীন সময়ে খুলনার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের চলাচলের জন্য প্রধান বাহন ছিল মির্জা খয়বার হোসেনের জিপ। এই জিপে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন আওয়ামীলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ।পরদিন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার খবর শুনে মানুষ যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে শত্রুবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫ শে মার্চের দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে মির্জা খয়বার বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাওয়ার পর ২৬ শে মার্চ সকালে করণীয় ঠিক করতে মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ আব্দুল করিম, বয়রা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ দবিরুল ইসলাম, বয়রা ও মহম্মদ নগর এলাকার অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ সহ শত শত সাধারণ মানুষকে নিয়ে বয়রা সার্কিট হাউস মাঠে এক আলোচনায় মিলিত হন। উক্ত আলোচনা সভা থেকে যশোর রোড সংলগ্ন বৈকালী ও বয়রা এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কারন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর খুলনা শহরে প্রবেশের জন্য যশোর রোড ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ। এ কারনে সভা থেকে বয়রা এবং বৈকালী এলাকায় যশোর রোড সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। বয়রা বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরীর সামনের কালভার্টটি ভেঙে ফেলা হয়। মির্জা খয়বার হোসেনের নেতৃত্বে এতে
অংশ গ্রহন করেন তারই আপন বড় ভাই বয়রা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান নৌবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য মির্জা আফজাল হোসেন, শেখ দবিরুল ইসলাম, আওয়ামীলীগ নেতা শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ, শেখ আব্দুল করিম, আওয়ামীলীগ নেতা শেখ আব্দুল গফফার (নেতা গফফার), আওয়ামীলীগ নেতা মোল্লা আবু জাফর (জফা), শেখ ছরোয়ার উদ্দিন আহমদ (শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ এর সহোদর), শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ (শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ এর সহোদর), শেখ আব্দুল ওয়াদুদ (শেখ আব্দুল করিম এর ভাতিজা), এস এম মঞ্জুর-উল-আলম, শেখ নূর মোহাম্মদ, কাজী নজরুল ইসলাম, শেখ মনিরুল ইসলাম (শেখ দবিরুল ইসলাম এর সহোদর), শেখ আবুল বরকত, কাজী সরোয়ার বক্তিয়ার দুলু, মল্লিক সুলতান আহমেদ, হাবিবুর রহমান,নাসির মাস্টার, জিন্নাহ মাস্টার, আব্দুল হামিদ, কালিপদ, নুরুল হক, শেখ সালাহউদ্দীন মল্লিক সহ শত শত মানুষ।

বয়রা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উদ্যোগে প্রতিরোধ যুদ্ধে আগ্রহী স্থানীয় যুবকদের এর পূর্বেই সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বয়রার স্কুল মাঠে এই ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিংয়ে নেতৃত্ব দেন বয়রা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মির্জা আফজাল হোসেন এবং তৎকালীন বয়রা আর আর এফ পুলিশ ক্যাম্পের প্রধান সুবেদার হাবিলদার শামসুর রহমান, পুলিশ ক্যাম্পের সদস্য হাবিলদার সাঈদুর রহমান সহ আরও একজন। ২৬ শে মার্চ বৈকালী এলাকাস্থ যশোর রোড সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর আর এফ ক্যাম্পের প্রধান সুবেদার হাবিলদার শামসুর রহমান রাইফেল, গুলি, বারুদসহ ১৩ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে যশোর রোডের দিকে রওনা হন। তখন মির্জা আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে আর আর এফ ক্যাম্পের অস্ত্রাগার ভেঙে রাইফেল, গোলাবারুদ লুট করা হয়। এর পূর্বেই মির্জা খয়বার হোসেনের উদ্যোগে তার বটিয়াঘাটাস্থ পরিত্যক্ত বাড়িতে বানানো বিপুল পরিমাণ বোমা প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে মির্জা খয়বার হোসেনের নির্দেশে নিয়ে আসা হয়। তাছাড়া পূর্বেই বিভিন্ন বন্দুকের দোকান থেকে লুট করা কিছু রাইফেল, গোলাবারুদ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কাছে ছিল।এসব বোমা,রাইফেল এবং গোলাবারুদ নিয়ে নেতৃবৃন্দ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা হানাদার বাহিনীর উপর আঘাত হানার জন্য তৈরি হয়ে যায় এবং যশোর রোডের দুই পাশে অবস্থান নেয়। তাদের সাথে স্থানীয় অসংখ্য মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে লাঠি,বল্লম নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। ২৭ শে মার্চ যশোর রোড হয়ে খুলনা প্রবেশের সময় পাক কনভয় নােয়াপাড়া ও ফুলতলায় বাধাগ্রস্থ হয়। এরপর তারা অতি সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল। ফুলবাড়ি গেট অতিক্রম করে ধীর গতিতে আসছিল। কিন্তু দৌলতপুরের প্রবেশদ্বার রেলী গেটে প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল তা দেখে নেমে পড়ে এবং ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলে ফের রওনা হয়। দৌলতপুর মােড় অতিক্রমকালে দৌলতপুরের এক তরুণ হিডি এই কনভয়ের উপর ২২ বাের রাইফেল দিয়ে এক দালানের ছাদ থেকে পর পর কয়েকটি গুলি করে, আহত হয় পাকসেনাদের কয়েক জন। সকল বাধা মোকাবিলা করে প্রায় বেলা ১২টার দিকে পাকসেনাদের কনভয়ের ৩/৪ টা গাড়ি গােয়ালখালি অতিক্রম করলে মির্জা খয়বার হােসেন খবর পেয়ে সকলকে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। এক দল আশ্রয় নেয় বৈকালী সিনেমা হলের ভেতর, অন্যদল খুলনা বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরীর ভেতর। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের তিন চারটি গাড়ি এসে যায়। সাথে সাথে শুরু হয় রাইফেল ও বন্দুকের গুলি। পাকসেনারা বিপদ দেখে যশাের রােডের পূর্ব দিকে দ্রুত নেমে পড়ে পজিশন নেয় এবং বৈকালী সিনেমা হল লক্ষ্য করে ব্যাপক গােলাবর্ষণ করতে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও বেপরােয়া হয়ে গােলাগুলি অব্যাহত রাখে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকসেনারা মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে বৈকালী সিনেমা হলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের একমাত্র টার্গেট তখন বৈকালী সিনেমা হল। কারণ সিনেমা হলের ভিতর থেকেই তাদের দিকে প্রচন্ডভাবে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। পাকসেনারাও বৃষ্টির মতাে গুলি ছুড়তে থাকে। ফলে সিনেমা হলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পক্ষে আর কোন মতেই টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

পাবলিক লাইব্রেরী ও বয়রা গার্লস কলেজের ভিতর থেকে তখন শুরু হয় আক্রমণ।পাকসেনারা তখন পাবলিক লাইব্রেরী ও মহিলা কলেজের দিকে আক্রমণ শুরু করে।পাকসেনাদের লক্ষ্য করে অনেক বােমা ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সেগুলাে তেমন কাজে আসেনি। বয়রা মহিলা কলেজের সামনে ছিল প্রচুর ইটের গাদা। সিএন্ডবি’র এই ইটের ঢিবির পিছন থেকে একদল তরুণ কয়েকটা আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের একজন নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। এ সময় পুলিশের সিপাহী মুন্সি মোজাম্মেল হক এক ইটের গাদা থেকে পজিশন পরিবর্তন করে অন্য ইটের গাদায় যাওয়ার সময় পাকসেনাদের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সাথে সাথেই মারা যান এই অকুতােভয় যােদ্ধা। বিকেল ৪টা পর্যন্ত দু’পক্ষ ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। পাকসেনাদের আরাে ২০/২৫ টি গাড়ি চলে আসে। তখন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটে গেলে পাকসেনারা খুলনা শহরে প্রবেশ করে। এই যুদ্ধে এইচ এন্ড পোদ্দার কোম্পানীর একজন শ্রমিকও মারা যান। যুদ্ধ শেষে বয়রা রিজার্ভ ক্যাম্পের সিপাহী পি আর এফ নম্বর-১৩৪, শহীদ মুন্সি মােজাম্মেল হককে বৈকালী বাজার থেকে সামান্য দূরে বকুলতলায় দাফন করা হয়। এই শহীদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার মোকছেদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। তার এই আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে বয়রাবাসী স্মরণ করবে। বয়রা যুদ্ধের পরদিন ২৮শে মার্চ খুলনা থেকে কয়েক গাড়ি মিলিটারী এসে বয়রা এলাকায় ব্যাপক তান্ডব চালায়। স্থানীয় জনসাধারণের অনুরােধে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ও জানমালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রতিরােধ না করে পিছু হটে যায়। বয়রা যুদ্ধের ফলাফল যাই হােক না এর তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।কারন এই যুদ্ধের পরেই হানাদার বাহিনী মির্জা খয়বার হোসেন সহ নেতৃবৃন্দকে খুঁজতে থাকে। এমনকি মির্জা খয়বার হোসেনকে ধরার জন্য খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে পুরস্কার ও ঘোষণা করা হয়। পরে হানাদার বাহিনী তার সদলবলে বটিয়াঘাটায় অবস্থানের কথা জানতে পারার পর তার বটিয়াঘাটার চকরাখালিস্থ বাড়ি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাড়ি লক্ষ্য করে অসংখ্য শেল নিক্ষেপ করে। এতে অনেক বাড়ি ভস্মীভূত হয়। তবে মির্জা খয়বার হোসেন সহ তার সাথে থাকা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য এবং আওয়ামীলীগের নেতৃস্থানীয়রা অক্ষত থাকেন। অতপর মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে যান মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ আব্দুল করিম, মির্জা আফজাল হোসেন,শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ, শেখ দবিরুল ইসলাম,শেখ আব্দুল গফফার, মোল্লা আবু জাফর জফা,শেখ আব্দুল ওয়াদুদ (শেখ আব্দুল করিম এর ভাতিজা),শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ (শেখ হেসাম উদ্দিন এর সহোদর), শেখ সরোয়ার উদ্দিন আহমদ (শেখ হেসাম উদ্দিন এর সহোদর), শেখ সারাফাত উদ্দিন আহমদ ছকো (শেখ হেসাম উদ্দিন এর সহোদর), মির্জা তসলিম হোসেন (মির্জা আফজাল হোসেন ও মির্জা খয়বার হোসেন এর সহোদর), শেখ আবুল বরকত (বয়রা শ্মশানঘাট এলাকার আওয়ামীলীগ নেতা), শেখ আছাদ উল্লাহ (শেখ হেসাম উদ্দিন এর পুত্র), শেখ হাসান আবু জাফর ঝন্টু (শেখ আব্দুল করিম এর পুত্র), শেখ হাসান সরোয়ার (শেখ আব্দুল করিম এর বড় পুত্র), শেখ সহিদ উল্লাহ (শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ এর বড় পুত্র), শেখ ইসহাক আহমেদ প্রমুখ ব্যক্তিগণ। আওয়ামীলীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ সদস্য ভারত চলে যান। একই সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হত্যা,খুন,অত্যাচার,
নির্যাতন,অগ্নিসংযোগে ভীতসন্ত্রস্ত হাজার হাজার সাধারন মানুষ এবং আওয়ামীলীগ সহ স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী যুবক ভারত যান। এদের জন্য ভারতের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন শরনার্থী শিবির এবং যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্র (Youth Reception Camp) গড়ে তোলা হয় মুজিব নগর সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে। এসব যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্রের কোনো কোনোটিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক জড় হওয়া যুবকদের স্বল্পকালীন সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করা হয়। আবার আগ্রহী অনেক যুবককে বীরভূম,চাকুলিয়া প্রভৃতি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। এসব যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব পান ৭০’র নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ এবং বিভিন্ন এলাকার আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃববৃন্দ।অধিকাংশ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন নির্বাচিত এম.এন.এ এবং এম.পি.এ গণ। তবে মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ আব্দুল করিম কিংবা মির্জা আফজাল হোসেন নির্বাচিত এম.এন.এ কিংবা এম.পি.এ না হয়েও ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পান। মির্জা খয়বার হোসেন ছিলেন বশিরহাটের “তেতরা ক্যাম্প/ “ভ্যাবলা ক্যাম্প” এর ক্যাম্প ইন-চার্জ। তিনি ছিলেন খুলনার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির কয়েকজন সংগঠকের একজন। বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ রাতে খুলনায় একমাত্র তাকে টেলিফোন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সেই ঐতিহাসিক বার্তাটি দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এই ঘটনাটির কারনেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন।

তেতরা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন ছোট বয়রার আওয়ামীলীগ নেতা ষাটের দশকের “মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য”(B.D Member/ Basic Democrats Member) শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ। শেখ হেসাম উদ্দিনের পরিবার ছিল বয়রা, মহম্মদ নগর এলাকার সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক এই পরিবারের ১৭ টি ঘর পোড়ানো হয়েছিল। শেখ হেসাম উদ্দিন এর সহোদর শেখ মহিউদ্দিন আহমদ (বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাফিজ উল্লাহ’র পিতা) এর মালিকানাধীন বয়রা বাজারে অবস্থিত রাইস মিল পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।শেখ হেসাম উদ্দিনের সহোদর শেখ জালাল উদ্দিন আহমদকে হানাদার বাহিনীর দোসররা শ্রীফলতলা ইউনিয়নের জোয়ার গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়।দিনটি ছিল পবিত্র শবেবরাত এর দিন।তিনি ভাগ্যক্রমে কোনমতে বেঁচে ফেরেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হেসাম উদ্দিনের পরিবারকে দীর্ঘদিন তাবুর নিচে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। শেখ হেসাম উদ্দিন ছিলেন আওয়ামীলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। শেখ হেসাম উদ্দিনের এক ভাই ছিলেন শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা।শেখ কুতুব উদ্দিন ছিলেন একজন দূর্ধর্ষ সম্মুখ যোদ্ধা। তিনি ছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার। বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দেন। খুলনা বেতার কেন্দ্র প্রতিরোধ যুদ্ধের সাহসী সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন তিনি। ৬০’র দশকে মুসলিম লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত খুলনায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার শঙ্কা ছিল। এ কারনে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নিরাপত্তার জন্য মির্জা খয়বার হোসেন এর নেতৃত্বে খুলনার বিশেষ করে বয়রা,মহম্মদ নগর এলাকার আওয়ামীলীগের নিবেদিতপ্রাণ কিছু সাহসী যুবককে নিয়ে ‘নিরাপত্তা বাহিনী’ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু খুলনায় কোন রাজনৈতিক সফরে আসলে মির্জা খয়বার হোসেনের নেতৃত্বে কথিত এই নিরাপত্তা বাহিনী বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন। এই বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ।
শেখ হেসাম উদ্দিনের অন্য দুই ভাই শেখ সরোয়ার উদ্দিন আহমদ (ছরো) এবং শেখ সারাফাত উদ্দিন আহমদ (ছকো), দুই পুত্র শেখ শহিদ উল্লাহ্ ও শেখ আছাদ উল্লাহ্ এবং ভাতিজা শেখ হাফিজ উল্লাহ্, শেখ ওবায়দুল্লাহ্ রনো এবং চাচাতো ভাই শেখ মোকছেদ আলি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী সম্মুখ যোদ্ধা। শেখ সারাফাত উদ্দিন আহমদ (ছকো), শেখ সরোয়ার উদ্দিন আহমদ (ছরো), শেখ আছাদ উল্লাহ্ এবং শেখ শহিদ উল্লাহ্ ভারতের সেনাবাহিনী পরিচালিত বিহারের চাকুলিয়া ট্রেনিং সেন্টার থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বটিয়াঘাটা থানা আক্রমণ এবং ডুমুরিয়ার রানাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণে সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেছেন শেখ হেসাম উদ্দিনের তিন ভাই কুতুব,ছরো ও ছকো এবং পুত্র আছাদ উল্লাহ্। শেখ কুতুব উদ্দিন ছাড়াও খুলনায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা টিমের সদস্য ছিলেন তার আরেক ভাই শেখ সরোয়ার উদ্দিন আহমদ (ছরো)।

তেতরা/ভ্যাবলা ক্যাম্পের স্টোর ইন-চার্জ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আরেক স্নেহভাজন ৬০’র দশকের মধ্যভাগে মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা শেখ আব্দুল গফফার। যিনি পরবর্তীতে ‘নেতা গফফার’ নামে পরিচিতি পান। ৬০’র দশকে মহম্মদ নগর ও বয়রা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত করতে দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা হিসেবে অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন তিনি। তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের একজন দক্ষ সংগঠক। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন বয়রার আওয়ামীলীগ নেতা মোল্লা আবু জাফর (জফা) ছিলেন এই ক্যাম্পের একজন ইন্স্ট্রাক্টর। তিনি ছিলেন একজন সাহসী সম্মুখ যোদ্ধা। বটিয়াঘাটা থানা আক্রমণ এবং ডুমুরিয়ার রানাই প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের প্রথম সারির সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন তিনি।বয়রার আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত করতে তার অবদান অত্যধিক। দল এবং দলের কর্মিদের পিছনে তিনি দু’হাত খুলে অর্থ ব্যয় করতেন। তিনি একজন কর্মিবান্ধব নেতা ছিলেন।স্বাধীনতার পর থেকে ২০১২ সালের ৬ ই জানুয়ারি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘবছর তিনি মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক অকুতোভয় সৈনিক।তিনি বঙ্গবন্ধুর খুলনা সফরের সময় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন খুলনায় আসতেন তখন তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মির্জা খয়বার হোসেন,শেখ আব্দুল ওয়াদুদ, শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ, মোল্লা আবু জাফর জফা,শেখ সরোয়ার উদ্দিন আহমদ ছরো,শেখ দেলোয়ার হোসেন ছাড়াও থাকতেন মোঃ আলম খোকন।যিনি পরবর্তীতে ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাথে আমৃত্যু সম্পৃক্ত ছিলেন।

অপরদিকে ৯ নং সেক্টরের অধীন টাকী ক্যাম্প গড়ে তোলার শুরু থেকেই এর সাথে যুক্ত ছিলেন ৫০ দশকের শুরু থেকেই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত শেখ আব্দুল করিম।শেখ আব্দুল করিম ছিলেন আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন দলের প্রাথমিক সদস্য। ৬০’র দশকের মৌলিক গণতন্ত্রী ( B D Member/ Basic Democrats Member) শেখ আব্দুল করিম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি। ৫০’র দশক থেকেই তিনি মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রধান সংগঠক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার মালিকানাধীন খুলনা বড় বাজারের ১০ নং ক্লে রোডের ‘হাসান স্টোর’- এ বসে আওয়ামীলীগের অনেক সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালিত হত। এ কারনে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দোকানটি একাধিকবার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসরদের দ্বারা লুট হয়। শেখ আব্দুল করিম টাকী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার শুরুতে অনেকদিন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে ক্যাশিয়ার-কাম- সুপারভাইজারের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ১৯৭২ সালের শুরু থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ বছর অত্যন্ত সততা এবং নিষ্ঠার সাথে ‘রিলিফ কমিটি’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। খুলনার মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবারের ভূমিকার কথা সকলের জানা। তার ভাতিজা শেখ আব্দুল ওয়াদুদ ছিলেন একজন দূর্ধর্ষ সম্মুখ যোদ্ধা। টাকি যুব অভ্যর্থনা ও তেতরা/ভ্যাবলা ক্যাম্প হয়ে ভারতের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বিহারের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়া শেখ ওয়াদুদ অনেক সম্মুখ যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার। তিনি ডুমুরিয়ার রানাই প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ এবং বটিয়াঘাটা থানা আক্রমণে অসীম সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দেন। খুলনা বেতার কেন্দ্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ও একজন সাহসী সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন তিনি।বঙ্গবন্ধুর খুলনা সফরের সময় মুসলিম লীগের ঘাঁটি খুলনায় তার নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তার নিরাপত্তার জন্য যে স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা হয়েছিল,সেই টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন শেখ আব্দুল ওয়াদুদ। শেখ আব্দুল করিমের আরেক ভাতিজা শেখ দেলোয়ার হোসেন ও ছিলেন খুলনায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা টিমের আরেক সদস্য।শেখ আব্দুল করিমের দুই পুত্র শেখ হাসান সরোয়ার এবং শেখ হাসান আবু জাফর ঝন্টু ও ছিলেন সাহসী সম্মুখ যোদ্ধা। খুলনা মুক্ত হওয়ার ঠিক এক বা দু’দিন পূর্বে খুলনা বেতার কেন্দ্র দখলের জন্য যে পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হয়েছিল সেই আক্রমণের একজন সাহসী সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন শেখ হাসান আবু জাফর ঝন্টু। শেখ আব্দুল করিমের পরিবারের আরেক সদস্য শেখ ইসহাক আহমেদ ও এই যুদ্ধের আরেকজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।

টাকী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার শুরুতে ক্যাম্প কমান্ডার এবং পরবর্তীতে ক্যাম্প ইন-চার্জ ছিলেন খুলনা শহর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান বৃহত্তর খুলনার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক মির্জা খয়বার হোসেনের বড় ভাই মির্জা আফজাল হোসেন। তিনি মে মাসের প্রথমদিকে ভারতে গমন করে ৯ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য এম এ গফুরের নির্দেশে এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের তত্ত্বাবধানে টাকি যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তোলেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্প প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ দক্ষ সংগঠক। সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে ফ্রিডম পার্টির উত্থানকালীন সময়ে ১৯৮৬-‘৯২ সাল পর্যন্ত ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের আহবায়ক এবং ৯২-৯৬ মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আওয়ামীলীগকে দুঃসময়ে সংগঠিত করেছেন এই নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে একাধিকবার তাদের বড় বয়রার ঐতিহ্যবাহী ‘মির্জা বাড়ি’ তে এসেছেন এবং আতিথেয়তা গ্রহন করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে এই পরিবারের অবদান অপরিসীম। মির্জা আফজাল হোসেনের ছোট ভাই মির্জা তসলিম হোসেন ও ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। তিনি ছিলেন টাকি ক্যাম্পের একজন ইনস্ট্রাক্টর।তার আরেক ভাই মির্জা এমদাদ হোসেন ছিলেন ডাক বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা।মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসরদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হন তিনি। তার তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করায় তাকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা।কিন্তু সাথে আইডি কার্ড থাকায় তিনি প্রাণে রক্ষা পান।

বয়রা অঞ্চলের আরেক কৃতি সন্তান ছিলেন শেখ দবিরুল ইসলাম (দবির চেয়ারম্যান)।মুক্তিযুদ্ধকালীন বয়রা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন।বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে ১৫ জন কো-অপ্ট কাউন্সিলর মনোনীত হয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন তিনি। তিনি তকিপুর ক্যাম্পের সিকিউরিটি ইন-চার্জ ছিলেন। পাশাপাশি তিনি এই ক্যাম্পের পলিটিক্যাল মটিভেটর এর দায়িত্বও পালন করেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তিনি নিষ্ঠার সাথে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তার ছোট ভাই শেখ মনিরুল ইসলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বৈকালি প্রতিরোধ যুদ্ধের একজন সাহসী সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বয়রা বাজারে অবস্থিত তাদের দোকান ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই অঞ্চলের আওয়ামীলীগের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন এফ এম মাকসুদুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ শে এপ্রিল পাকিস্তানী আর্মির হাতে বন্দী হন তিনি।তার উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।শরীরে নির্যাতনের সেই চিহ্ন এখনো বয়ে চলেছেন। কোনভাবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।তারপর দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। ০৯ নং সেক্টরের অধীন বাগুন্ডি ক্যাম্পের মেডিকেল অফিসার ছিলেন ডাঃ কাজী এমদাদুল হক (নেভী ডাক্তার)। তিনি ৮০’র দশকে মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক।তার সহোদর কাজী মুজিবুল হক ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপর ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন।তিনি ৮০’র দশকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ডাক্তার কাজী এমদাদের কন্যা কাজী সাকিনুর সেতু খুলনা সরকারি মহিলা কলেজের নির্বাচিত ভিপি ও জিএস ছিলেন।তিনি যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান সদস্য।তার ছোট ভাই কাজী রাকিবুল ইসলাম পলাশ বর্তমানে সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামীলীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক।

দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।অবশেষে ৩০ লক্ষ শহীদ আর আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ৯ মাস পর আসলো বাঙালীর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীর দীর্ঘ ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হল ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ হল বাঙালীর। যদিও খুলনা মুক্ত হয়েছিল এর একদিন পর ১৭ ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন,কলকাতা হয়ে দেশে ফিরে আসলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।১২ ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহন করলেন। টানা ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে অত্যাচার,নির্যাতনে ক্লান্ত বঙ্গবন্ধু অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে দেশে ফিরেই শুরু করলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত তলাবিহীন ঝুঁড়ির স্বাধীন বাংলাদেশ পূনর্গঠনের কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞের নিষ্ঠাবান,নির্লোভ এবং আদর্শিক কর্মবীর ছিলেন মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ আব্দুল করিম, মির্জা আফজাল হোসেন, শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ, শেখ দবিরুল ইসলাম, মোল্লা আবু জাফর (জফা), শেখ আব্দুল গফফার, শেখ আব্দুল ওয়াদুদ,শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ এবং এফ এম মাকসুদুর রহমান। শেখ দবিরুল ইসলাম এবং শেখ আব্দুল করিম খুলনা পৌরসভা, খুলনা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তিনবার করে কমিশনার নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৪ ও ১৬ নং ওয়ার্ডের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সূচনা তাদের হাত ধরে।

৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের নির্মম ট্রাজেডির পর মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামীলীগের স্থানীয় এসব সংগঠক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা চালায় অত্যাচার, নির্যাতনের স্টীম রোলার। বন্দি করা হয় মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ আব্দুল করিম এবং তার তিন পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাসান আবু জাফর ঝন্টু,শেখ হাসান আক্তার বুলু এবং শেখ হাসান বখতিয়ার বাকু কে অত্যাচার, নির্যাতনের বন্দিদশা হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন কিন্তু অবৈধ শাসকের সাথে আঁতাত করেন নি তারা। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনড় থাকার কারনে মোকাবিলা করতে হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা সহ অসংখ্য মামলা।দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছে কারাগারে। শেখ আব্দুল করিমের তিন পুত্র প্রায় ২১ দিন পর বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান। মির্জা খয়বার হোসেন ১৫ আগষ্টের পর টানা কয়েক বছর বন্দী ছিলেন। মির্জা আফজাল হোসেন, শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ, শেখ দবিরুল ইসলাম, শেখ আব্দুল গফফার, এফ এম মাকসুদুর রহমান এবং মোল্লা আবু জাফর জফার পরিবারের উপর ও চালানো হয়েছে অত্যাচার, নির্যাতন। এসব পরিবারের অনেক সদস্য দীর্ঘ বছর রাতে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামীলীগের নাম উচ্চারণ ছিল অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ।চারিদিকে তখন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।আওয়ামীলীগের অধিকাংশ এমপি এবং নীতিনির্ধারক তখন কারাগারে।সারাদেশটাই যেন এক বন্দীশালা! এমনি এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ চরম প্রতিকূলতাকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত করেছেন।

মির্জা খয়বার হোসেনকে ৭৯’র প্রহসনের নির্বাচনে যখন খুলনা-৪ আসনের আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় তখনো তিনি অবৈধ স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার কারাগারে বন্দী ছিলেন।নির্বাচনের মাত্র অল্প কয়েকদিন পূর্বে তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পান। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত করেন। দলের চরম দুঃসময়ে শহর আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। কর্মিবান্ধব নেতা ছিলেন।দলের কর্মিদের বিপদে, আপদে খোঁজখবর নিতেন।দলের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন।খুলনা শিশু ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মির্জা খয়বার ছিলেন সোনাডাঙ্গা প্রি ক্যাডেট স্কুল (বর্তমান খুলনা কলেজিয়েট স্কুল) এর প্রতিষ্ঠাতা। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক মির্জা খয়বার স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ছিলেন খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট এবং খুলনা রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন। মির্জা আফজাল হোসেনের বড় পুত্র মির্জা আহসান হাবীব (হাসান) ৮০ ও ৯০’র দশকে খুলনার ছাত্রলীগ,যুবলীগের রাজনীতির অন্যতম সাহসী সংগঠক ছিলেন। ছাত্রলীগ,যুবলীগের রাজনীতি করা মির্জা হাসান ৮০’র দশকে দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করার জন্য। তাদের বাড়িতে বোমা হামলা করা হয়েছে সরকারি মদদে। মির্জা হাসান দীর্ঘদিন ধরে ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত আছেন। মেজোপুত্র মির্জা আপ্পান হাবীব ৮০’র দশকের মধ্যভাগ থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে দলের দুঃসময়ে খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে খুলনার রাজপথে তার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় যৌথবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হন মির্জা আপ্পান হাবীব এবং মির্জা আশফাক জামান (মির্জা আফজাল হোসেন এর পুত্র)।তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা কোন ধরনের অভিযোগ না থাকলেও শুধুমাত্র আওয়ামী পরিবারের সন্তান হওয়ার কারনে তাদের উপর সেদিন টর্চার করা হয়েছিল। মির্জা আফজাল ও মির্জা খয়বারের ভাতিজি মির্জা রাফিয়া আক্তার (মির্জা এমদাদ হোসেন এর মেয়ে) বর্তমানে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য। ৯০ দশকের ছাত্রলীগ নেত্রী মির্জা রাফিয়া খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং বিএল কলেজে অধ্যায়নকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন।ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ছাত্রী/ছাত্র সংসদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন।

মোল্লা আবু জাফর জফার ভাতিজা মোল্লা হায়দার আলি জেনারেল জিয়ার শাসনামলের শেষদিকে সেই দুর্বিষহ দিনগুলোতে জয় বাংলার স্লোগান দিয়েছেন। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনের অধিকারী হায়দার আলি দীর্ঘদিন ধরে ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হিসেবে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তাকে ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের কান্ডারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি দীর্ঘ প্রায় ১৮-১৯ বছর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।শেখ দবিরুল ইসলামের চাচাতো ভাই শেখ মোসারাফ হোসেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ডের বর্তমান জনপ্রিয় কাউন্সিলর এবং দীর্ঘদিন ধরে খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। এক সময় বয়রা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেক অত্যাচার,নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন মুজিব আদর্শের রাজনীতি করতে গিয়ে,প্রতিদান পেয়েছেন পড়ন্ত বয়সে।

শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ ৮০’র দশকের শেষ মধ্যভাগে ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। চরম ক্রান্তিকালে ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে দলকে সংগঠিত করেছেন।দীর্ঘদিন মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। শেখ হেসাম উদ্দিনের ভাতিজা শেখ আবিদ উল্লাহ্ ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের বর্তমান সভাপতি। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ধরে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগকে নেতৃত্ব দেওয়া শেখ আবিদ উল্লাহর রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। ৮০ ও নব্বইয়ের দশকের তুখোড় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজপথের সকল আন্দোলন সংগ্রামে তার সরব উপস্থিতি ছিল।দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ, পরিচ্ছন্ন নেতা হিসেবে তার সুপরিচিতি রয়েছে। শেখ আবিদ উল্লাহর বড় দুই ভাই ও দীর্ঘ বছর ধরে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত আছেন। শেখ হেসাম উদ্দিনের কন্যা শাহানাজ পারভীন দীর্ঘদিন ধরে ১৬ নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।

শেখ আব্দুল করিম মুজিববাদে বিশ্বাসী ছিলেন।৭৫’র পর চরম দুঃসময়ে তিনি দীর্ঘদিন মহম্মদ নগর ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।সে সময় সাধারন সম্পাদক ছিলেন এফ এম মাকসুদুর রহমান। এই কমিটি দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৮২ সালের শেষ পর্যন্ত। মাকসুদুর রহমানের বাড়িতে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করার অপরাধে। এসব হামলা প্রতিরোধে সে সময় নেতৃত্ব দেন মির্জা খয়বার হোসেন,শেখ আব্দুল ওয়াদুদ,শেখ হাসান বখতিয়ার বাকু,শেখ হাফিজ উল্লাহ্ সহ অনেক নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামীলীগার। ৮৬ সালে ১৭ দিন জেল খেটেছেন মাকসুদুর রহমান।তিনি ছিলেন ৯৬ সালে খুলনার জনতার মঞ্চের প্রধান সংগঠক। শেখ আব্দুল করিম ৯২-৯৬ সাল পর্যন্ত ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলকে সুসংগঠিত করেছেন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামীলীগের সুবর্ণজয়ন্তীর (প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি)অনুষ্ঠানে আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর্যন্ত দলের রাজনীতিতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরুপ জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন।তার ভাতিজা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল ওয়াদুদ ৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।দলের পিছনে অনেক অর্থ ব্যয় করতেন তিনি।বয়রা ভাঙাপোল এর পাশে তার মিলে বসে মহম্মদ নগর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের অনেক কর্মকান্ড একসময় পরিচালিত হত। শেখ আব্দুল করিমের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ হাসান ইফতেখার চালু খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের বর্তমান সাধারন সম্পাদক। মহানগর আওয়ামীলীগের বিগত কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।একজন ভদ্র রাজনীতিক ও জনপ্রিয় সমাজসেবক হিসেবে তার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। তার আরেক পুত্র শেখ হাসান বখতিয়ার বাকু দীর্ঘবছর ধরে ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত আছেন। তার পুত্র শেখ হাসান আক্তার বুলু নিরবে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করতে অর্থ দিতেন। দল,মত নির্বিশেষে সকলের সাথে মেশার তার অসাধারন ক্ষমতা ছিল। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি আওয়ামীলীগার। শেখ আব্দুল করিমের ভাতিজা আলহাজ্ব শেখ মোশাররফ হোসেন খুলনার একজন বিশিষ্ট নাগরিক নেতা। খুলনা উন্নয়নের দাবিদাওয়া নিয়ে তিনি রাজপথে সবসময় থাকেন সরব।দীর্ঘদিন ধরে খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ছিলেন স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সহসভাপতি। বর্তমানে খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। শেখ আব্দুল করিমের সেজোপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাসান আবু জাফরের পুত্র তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা শেখ ফারুক হাসান হিটলু বর্তমানে খুলনা মহানগর আওয়ামীলীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।খুলনা সরকারি সুন্দরবন কলেজের ৯০’র দশকের জনপ্রিয় ভিপি হিটলু ২০০১ পরবর্তী আওয়ামীলীগের ক্রান্তিকালে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি হিসেবে খুলনার রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অবৈধভাবে গ্রেফতারের পর রাজপথে তার সাহসী ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। অনেকেই তাকে আগামি দিনের সম্ভাবনাময়ী পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব হিসেবে বিবেচনা করেন।

শেখ আব্দুল গফফারের পুত্র শেখ তরিকুল ইসলাম এবং ভাতিজা শেখ শরিফুল ইসলাম ও দীর্ঘবছর ধরে ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত।আওয়ামীলীগের দূর্দিনে ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ তরিকুল ইসলাম। তার ভাগ্নে মোঃ আলমগীর হোসেন বন্দ ৮০ ও ৯০ এর দশকে আওয়ামীলীগের অত্যন্ত সক্রিয় কর্মি ছিলেন। দীর্ঘদিন ১৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। শেখ আব্দুল গফফারের ভাগ্নি লুৎফুন নাহার লিলি বর্তমানে ১৬ নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি। তারা পারিবারিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও খুলনা জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারি এ্যাডঃ মমিনউদ্দীন আহমদ এর আত্মীয়।মমিনউদ্দীন আহমদ ছিলেন বয়রা তথা খুলনার কৃতি সন্তান।তবে ১৫ ই আগষ্টের পর মোস্তাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়ে বিতর্কিত হন।

এভাবে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পদক্ষেপে এবং স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ এই চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে সাম্য,মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ রাষ্ট্র পূনর্গঠনে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী অবৈধ সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। ৭৫’র
১৫ ই আগষ্টের পর থেকে অবৈধ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি সাত্তারের শাসনামলের শেষ পর্যন্ত জেল, জুলুম, অত্যাচার,নির্যাতন,হামলা,মামলা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে অটল থাকলেও দু’একজন জেনারেল এরশাদের আমলে বিভিন্ন চাপে পড়ে,পরিবার রক্ষার তাগিদে জাতীয় পার্টিতে নাম লেখালেও মনেপ্রাণে আসলে মুজিববাদ লালন করতেন বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকলের দৃঢ় বিশ্বাস। তবে শেখ আব্দুল করিম,মির্জা আফজাল হোসেন,শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ,মোল্লা আবু জাফর জফা,শেখ আব্দুল গফফার এবং শেখ আব্দুল ওয়াদুদ আমৃত্যু মুজিববাদে ছিলেন অটল,অবিচল। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন জাতির এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের জন্য পরপারে চলে গেছেন।কিন্তু রেখে গেছেন এক ঝাঁক দেশপ্রেমিক আদর্শিক মুজিববাদী বিশুদ্ধ রক্তের উত্তরসুরীদের যারা তাদের দেখানো পথে শত বাঁধা বিপত্তি,অত্যাচার নির্যাতন, হামলা, মামলাকে মোকাবিলা করে যুগ যুগ ধরে মুজিব আদর্শের প্রশ্নে রয়েছেন অবিচল,অটল। মির্জা খয়বার, মির্জা আফজালের পরিবার, শেখ আব্দুল করিম, শেখ দবিরুল ইসলাম ও শেখ হেসাম উদ্দিনের পরিবার, মোল্লা আবু জাফর জফা, শেখ আব্দুল গফফার এবং এফ এম মাকসুদুর রহমানের পরিবার যুগ যুগ ধরে মুজিববাদের ঝান্ডা ধরে রেখেছেন তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। সময়ের বিবর্তনে তাদের এবং তাদের পরিবারের অবদান আমরা ভুলে গেছি।বর্তমান প্রজন্ম হয়ত জানেই না খুলনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এসব সূর্য সন্তানদের সম্পর্কে,তাদের সংগ্রামী জীবন এবং দেশপ্রেম সম্পর্কে। তাই রাষ্ট্রের কাছে দাবি মুক্তিযুদ্ধের এসব আঞ্চলিক সংগঠক এবং সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া সাহসী বীরদের সংগ্রামী জীবন ও কর্মকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি সাহসী আদর্শিক নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক রক্তের যোগ্য উত্তরসুরি দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের এসব সংগঠক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই আমার মত মুজিব আদর্শের এক নগন্য কর্মির এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য মির্জা খয়বার হোসেন, শেখ আব্দুল করিম, মির্জা আফজাল হোসেন, শেখ হেসাম উদ্দিন আহমদ, শেখ আব্দুল গফফার, শেখ দবিরুল ইসলাম, মোল্লা আবু জাফর, শেখ আব্দুল ওয়াদুদ এবং শেখ কুতুব উদ্দিন আহমদ- মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জাতির এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে খুলনার কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা,সড়ক কিংবা বয়রার কোন প্রতিষ্ঠান বা রাস্তার নামকরণ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকার, মাননীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান মহোদয়া, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক এবং খুলনা-২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ সালাউদ্দীন জুয়েল মহোদয়ের কাছে এই দাবি করছি। জাতির এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।