চালের মূল্যবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যসীমা

0
646

এ এম এম শওকত আলী

গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই চালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে একাধিক পত্রিকায় খবর প্রকাশ করা হয়েছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিং নামে (সানেম) গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আরও পাঁচ লাখ মানুষ গরিব হয়েছে। এ ধরনের অভিমত গ্রহণযোগ্য বলে মতপ্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের এক বিশেষজ্ঞ। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, গরিব মানুষের মোট আয়ের শতকরা ৮০ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কিনতে। বিশেষজ্ঞের অভিমতে এ কথাও উল্লেখ করা হয়, দেশের তিন কোটি ৮০ লাখ গরিবের মধ্যে পাঁচ লাখ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি বলা যাবে না। চালের দাম কমলে তারা আবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাবে। এ কথা সত্যি, দারিদ্র্যসীমার বিষয়টি কোনো সময়েই স্থিতিশীল নয়। নানা কারণে এ সীমার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। যেখানে চাল দৈনন্দিন খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে প্রধান উপাদান, সেখানে এর মূল্য বৃদ্ধি হওয়া মানেই দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি, যা আশঙ্কাজনক। গত বছর থেকেই চালের মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়। এর কারণ কারও অজানা নয়।

পরপর দুই দফায় বন্যা ও পরে আমন ধানের উৎপাদন হ্রাস মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বিকল্প হিসেবে আমদানির চেষ্টাও করা হয়। সরকারই প্রথমে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, একমাত্র সরকারি খাতের আমদানি বাজারের মূল্য স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয় না, যদি না বেসরকারি খাতও আমদানি করার সুযোগ পায়। কারণ বেসরকারি খাতের আমদানিকৃত চাল সরাসরি বাজারে যায়। অন্যদিকে সরকারি খাতের আমদানিকৃত চাল বন্দরে খালাস হওয়ার পর গুদামজাত করা হয়। এর পর শুরু হয় খোলা বাজারে সহনীয় মূল্যে বিক্রি। এর পরিমাণও খুব বেশি নয়। অতীতের সব গবেষণায় দেখা যায়, খোলা বাজারে সহনীয় মূল্যে চাল বা গম বিক্রির পরিমাণ মোট চাহিদার তুলনায় ছিল নগণ্য। যেমন ১৯৯২-৯৩ থেকে ২০০১-০২ সময়ে এ খাতে বিক্রির সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ০ দশমিক ৪০ মিলিয়ন টন। এ পরিসংখ্যান ১৯৯৫-৯৬ সালের। উল্লিখিত বছরগুলোর অন্যান্য বছরে এর পরিমাণ ছিল বছরওয়ারি ০ দশমিক ০১ থেকে ০ দশমিক ১৮ মিলিয়ন টন। সাম্প্রতিককালের সার্বিক খাদ্য বিতরণের পরিসংখ্যানেও যে চিত্র দেখা যায়, তা আশাব্যঞ্জক নয়। গত ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই ১ থেকে ডিসেম্বর ২ তারিখ পর্যন্ত প্রায় এক মিলিয়ন টন চাল ও গম সরকারি খাতে বিতরণ করা হয়। এর পূর্ববর্তী বছরে একই সময়ে বিতরণকৃত খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৬৪ হাজার টন। অর্থাৎ অর্থবছর ২০১৫-১৬ থেকেই সরকারি মজুদ কম ছিল। একই সময়ে সরকার গরিবদের জন্য কেজিপ্রতি ১০ টাকা হারে চাল বিক্রি বন্ধ করে। প্রকাশিত খবরে আরও বলা হয়েছে, এ খাতে খাদ্যশস্য বিতরণ কর্মসূচির দু’বার সময়সীমা এগিয়ে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিতরণও ২০১৭ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে যে পরিমাণ বিতরণ করা হয়, তা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় কম। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, ২০১৭ সালে উল্লিখিত সময়ে খোলা বাজারে চাল-গম বিক্রির পরিমাণ ১৯৯২-৯৩ থেকে ২০০১-০২ সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। অর্থাৎ ওই সময়ে খোলা বাজারে বিক্রির চাহিদা কম ছিল, যা সাম্প্রতিক বছরে বৃদ্ধি পায়। এর মূল কারণ ২০১৭ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোটা চালের বাজারমূল্য ছিল কেজিপ্রতি ৪২ থেকে ৫০ টাকা। ২০১৬ সালে একই সময়ে কেজিপ্রতি ৩৩ টাকার কম। বর্তমান অর্থবছরে খোলা বাজারে চাল বিক্রির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে চাল ২ দশমিক ৪৮ লাখ এবং গম ৩ দশমিক ৪৯ লাখ টন। মোট ৫ দশমিক ৯৭ লাখ টন। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে খোলা বাজারে বিক্রির পরিমাণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার টন চাল এবং ৫৩ হাজার টন গম। ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৬-১৭ (ডিসেম্বর) পর্যন্ত সময়ের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গম বিক্রির পরিমাণ সব সময়ই অধিকতর ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে খোলা বাজারে গম চালের তুলনায় কম ছিল। অথচ সারা বছরে গম বিক্রির নির্ধারিত পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৪৯ হাজার টন। এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। এর ব্যাখ্যা হলো, বর্তমান সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদে গমের তুলনায় চালের পরিমাণ অধিকতর। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চালের পরিমাণ হলো ৫ দশমিক ৮০ হাজার টন এবং গমের পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ হাজার টন। মোট মজুদ আট লাখ টনেরও বেশি।

সরকারি মজুদের সূত্র প্রধানত দুই- এক. অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ; দুই. আমদানি। গত ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, গত দুই দশকের তুলনায় যে কোনো সালে চাল আমদানি বর্তমানে অনেক বেশি। এর প্রমাণ হিসেবে অর্থবছর ২০১০ থেকে ২০১৮ (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ের আমদানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানির পরিমাণ হলো ২২ লাখ ৫৯ হাজার টন, যা গত দুই দশকের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার কারণে সারাবছরে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ৭০ লাখ টনেরও বেশি। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারি সূত্রে চাল আমদানির পরিমাণ পাঁচ লাখ টনের সামান্য বেশি। এ থেকে অনুমান করা যায়, খাদ্যশস্য আমদানিতে বেসরকারি খাতই মূল চালিকাশক্তি। খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক গবেষণায় প্রকাশ, ১৯৯৮-৯৯ সালের আমদানির পরিসংখ্যানও এ ধারণাকে প্রমাণ করে। ওই বছর সরকারি সূত্রে মোট খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল মোট সাত লাখ ৭০ হাজার টন। পক্ষান্তরে ওই বছর বেসরকারি খাতের আমদানি ছিল ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টন। বিশ্নেষকদের মতে, বর্তমান অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানির কারণ প্রধানত দুটি- এক. আমন ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হ্রাস; দুই. বেসরকারি চালকলে বোরো ধানের মজুদ কম। এর সঙ্গে যোগ করা যায় খাদ্যশস্য আমদানির শুল্ক্কহার গত আগস্ট মাসে ১০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে হ্রাস। তবে আশঙ্কার কারণ হলো, সরকারি ও বেসরকারি খাতের অধিকতর আমদানি সত্ত্বেও চালের বাজারমূল্য উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস হয়নি। এটা গরিবদের জন্য শঙ্কার কারণ।

অধিকতর আমদানি মানেই বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে সরবরাহ পর্যাপ্ত হলে মূল্য হ্রাস হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে এর কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। অধিকতর আমদানির প্রমাণ হলো, গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চাল আমদানির লক্ষ্যে ৩২ লাখ টন ঋণপত্র খোলা হয়। চাল ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, আমদানির মাত্রা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় কেজিপ্রতি চালের দাম বর্তমানে বেশি। আমদানি বৃদ্ধি বা হ্রাস নিয়ে ভোক্তারা মাথা ঘামায় না। সহনীয় মূল্যে চাল কিনতে পারলেই তারা খুশি। সাধারণ নিয়মে চালের দাম কমলে, বিশেষ করে ফসল কাটার কিছু আগে বাজারে চালের দাম কমলে কৃষকদের ক্ষতি হওয়ার কথা। কারণ, এ পরিস্থিতিতে তারা ধানের দামও কম পাবেন। আসলে দাম বাড়লেই যে কৃষকরা খুব লাভবান হবেন, তা নয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা ধান কাটার মৌসুমে অভাবী বিক্রি (উরংঃৎবংংবফ ঝধষব) করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া রয়েছে বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব। এক বিশেষজ্ঞের মতে, চালের বাড়তি দামের লাভ এবার মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছেই গেছে। আমদানির কারণে সরকারি মজুদ সন্তোষজনক। ৭ জানুয়ারি এ মজুদের পরিমাণ আট লাখ ৫৭ হাজার টন ছিল। এর মধ্যে চালের পরিমাণ পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টন। বাকিটা গম। আমনের সরকারি সংগ্রহ হয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার টন। টার্গেট তিন লাখ। সংগ্রহ অভিযান আগামী মার্চ পর্যন্ত চলবে। সরকারি সন্তোষজনক মজুদের ক্ষেত্রে সাধারণ ধারণা হলো, মজুদ ভালো হলে চালের বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার পূর্বশর্ত হলো সরবরাহ বৃদ্ধি। ১৯৯৮-৯৯ সালে চালের বাজারমূল্য অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ ওই সালে বেসরকারি খাতের আমদানির পরিমাণ ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টন ছিল। সরকারি আমদানির পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৭০ হাজার টন। এবার বাজারমূল্য না কমার কারণ- ক. আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি; খ. বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে সরবরাহের স্বল্পতা এবং গ. ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন।

সাধারণ ভোক্তাদের জন্য একমাত্র বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া অন্যান্য বিষয় বোধগম্য নয়। এ বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে চালের বাজারমূল্য হ্রাস পাবে কি? এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। একটি মত হলো, বোরো ধানের অধিকতর ফলনে বাজারের দাম সহনীয় হবে। ভিন্নমত হলো, ২০১৮ সালেও চালের বাজারমূল্য কমবে না।

তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা