খুলনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরাই রোগী পাঠাচ্ছেন প্যাথলজিতে!

0
1473

কামরুল হোসেন মনি:
নগরীতে সরকারি জেনারেল হাসপাতালে গাইনী বিভাগে আগত রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি তাদের মনোনীত প্যাথলজিতে যাওয়ার জন্য ভিজিটিং কার্ডও ধরিয়ে দেন। তা না হলে টেস্টের রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না, এমনই মন্তব্য চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। পাশপাশি রয়েছে ওষুধ প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য। এতে হতদরিদ্র রোগীরা নিরুপায় হয়ে ডাক্তারের মনোনীত প্যাথলজিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, আর এই টেস্টের ৫০ শতাংশ কমিশন পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এমন অভিযোগের তীর গাইনী বিভাগে মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফারহানা হকের বিরুদ্ধে।
তিনি লিয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও টপ চয়েজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামসহ পৃথক দুইটি ভিজিটিং কার্ডে তার নিয়মিত রোগী দেখার কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের দালালরা বাইরে ওৎ পেতে থাকে, চেম্বার থেকে রোগীরা বের হলে তাদের প্যাথলজিতে নিয়ে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন গেলে খুলনা সদর হাসপাতালের গাইনী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের টেস্টের জন্য চিকিৎসকদের মনোনীত প্যাথলজির ভিজিটিং কার্ড দেওয়ার চিত্র চোখে পড়ে। কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বললে তারা জানান, ডাক্তার নিজেই কোন প্যাথলজিতে যাবো তাও নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, তা না হলে রিপোর্ট দেখেন না।
সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ মোঃ আতিয়ার রহমান শেখ বলেন, আমি কয়েকদিনের জন্য দায়িত্বে আছি। সিভিল সার্জন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার পর ওই সব অভিযোগের বিষয়ে তিনি খতিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
সদর হাসপাতালের গাইনী বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফারহানা হক বলেন, রোগীরা জিজ্ঞাসা করলে আমি তো বলবো ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যান। এটা বলার আমার অধিকার আছে। সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট তো ভালো হয় না। এটাতো আমি বলতেই পারি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি আমার সাথে সরাসরি এসে কথা বলেন।
সদর হাসপাতাল অফিস সূত্রে জানা যায়, গাইনী মেডিকেল অফিসার ডাঃ রোজিনা আফরোজ ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর বদলি হয়ে হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যান। তিনি চলে যাওয়ার পর ডাঃ ফারহানা হক এখানে এসে যোগদান করেন।
গাইনী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে নাদিরা (৩০)। তিনি গাইনী বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফারহানা হককে দেখিয়ে বাইরে আসেন। হাতে ভিজিটিং কার্ড ও লিয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের খাম হাতে। হাতে ভিজিটিং কার্ড জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডাক্তার আপা টেস্ট করানোর জন্য এই প্রতিষ্ঠানে যেতে বলেছেন। ওইখানে তিনিও বসেন। কার্ডে উল্লেখ রয়েছে। ভাই, টেস্ট কি কম টাকায় হবে না, বেশি লাগবে এমন প্রশ্ন প্রতিবেদককে বললে, ডাক্তার আপা কি বলেছেন জানতে চাওয়া হলে রোগী নাদিরা বলেন, আপা এখান থেকেই টেস্ট করে এনে তাকে দেখানোর কথা বললেন। আরও এক রোগী দিলরুবা (২২)। তিনি গাইনী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। তাকেই একইভাবে ভিজিটিং কার্ড ও লিয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের খাম ধরিয়ে দেন। যে সব রোগীদের টেস্টের প্রয়োজন হচ্ছে সবাইকে একইভাবে ডাঃ ফারহানা হক তার মনোনীত লিয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও টপ চয়েজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্টের জন্য পাঠাচ্ছেন।
ওই সব রোগী বাইরে আসামাত্র টপ চয়েজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মহিলা দালাল কচি বেগম ওই সব রোগীদের তাদের চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ডাঃ ফারহানা হক এর দুই ভিজিটিং কার্ডে দুই প্যাথলজি সেন্টারের নাম উল্লেখ রয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানে তিনি রোগী দেখছেন। টপ চয়েজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওই ডাক্তার রোগী দেখার সময় বিকেল ৪টা রাত ৯টা উল্লেখ থাকলেও লিয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীর দেখার সময় উল্লেখ না থাকলেও সিরিয়ালের জন্য সময় উল্লেখ করা আছে। প্রতিটি ভিজিটিং কার্ডে ডাঃ ফারজহানা হকের নাম তার পদবী ও সরকারি হাসপাতালের মনোগ্রাম দেওয়া আছে। এছাড়া এর বাইরে নগরীর বিভিন্ন প্যাথলজি সেন্টারের দালালদের গাইনী বিভাগ ও আশপাশে ওৎ পেতে থাকতে দেখা যায়। একটা রোগী তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে দিলেই স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের দালালারা নিয়ে যাচ্ছেন। আর ওই সব টেস্টের ওপর ৫০ শতাংশ কমিশন চিকিৎসকরা পেয়ে থাকেন। লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিয়োজিত আছে দালাল হিসেবে পরিচিত পরিতোষ কুমার। তিনি হুট-হাট করে প্রায় সময় গাইনী বিভাগের মহিলাদের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের আনাগোনা। চিকিৎসা নিতে আসা আফরোজা খানম এ প্রতিবেদককে বলেন, গাইনী বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা মহিলারা নানান সমস্যার কথা ডাক্তারের কাছে তুলে ধরেন। পুরুষরা এসে ঘুরঘুর করলে বলতে নিজের কাছেই লজ্জা পেতে হয়। অনেক সময় ওই লোকরা ডাক্তারের সামনে বসে থাকেন। কেউ বা মহিলা রোগীর বসার স্থানে বসে থাকেন। বের হলেই ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন টানাটানি করেন। এতে বিরক্ত লাগে।
আক্ষেপ করে অপর রোগী সুলতানা সুমী বলেন, আমাদের মতো গরিব মানুষের ডাক্তারের কাছে না আসাই ভালো। ওষুধ খাওয়ার আগেই প্যাথলজির পরীক্ষার টাকা জোগাড় করতে হয়। ডাক্তারের কাছে আসলেই আগে পরীক্ষা, তাও আবার তারাই ঠিক করে দেন। কোন পরীক্ষা দরকার কোনটা নেই আমরা কিভাবে বুঝবো।