খুলনায় ৩৪৬ মাদক ব্যবসায়ী

0
724

স্টাফ রিপোর্টার:
খুলনায় মরণনেশা মাদক ব্যবসার সঙ্গে ২৭২ ব্যক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। পুরো মাদক চোরাকারবার ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন ৩৪ জন পুলিশ সদস্য। মোট ৩৪৬ জনের এমনই একটি তালিকা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে খুলনায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ, জনপ্রতিনিধি ও নেতা, পুলিশ, সাংবাদিকসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নাম থাকায় ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
খুলনা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, তালিকার সিংহভাগই সরকারি দলের নেতা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিক। তাই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা। তবে, তালিকায় থাকা ছোটখাটো মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে খুলনার পুলিশ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সরকারের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা গত বছর পুরো খুলনায় তদন্ত করে মাদক ব্যবসায়ী, এর পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারীদের তালিকা তৈরি করে। এরপর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আবার তদন্ত ও যাচাই-বাছাই করে ৩৪৬ জনের তালিকা পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও জননিরাপত্তা বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর তালিকাটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) গত ১৫ মার্চ, ১৭৪ নম্বর স্মারকের ওই তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়কে আদেশ দেন।
খুলনা জেলা ও মহানগরে মাদক চোরাকারবারে ও সরবরাহে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন ৩৪ জন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে জেলা পুলিশের দুই থানার দুই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ১২ জনের নাম আছে। বাকি ২২ জন খুলনা মহানগর পুলিশে (কেএমপি) কর্মরত।
ফুলতলা থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, তার এলাকায় কোনো মাদক ব্যবসা নেই। তারপরও নিয়মিত অভিযান চলে।
দিঘলিয়া থানার ওসি হবিবুর রহমান। মাদকের ব্যাপারে তার জিরো টলারেন্স রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
জেলা পুলিশ সুপার নিজাম-উল হক তালিকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। নাম আসা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেএমপির মুখপাত্র এডিসি সোনালী সেন জানান, এই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনায় মাদক ব্যবসা ও মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত ২৭২ জন ব্যক্তি। এর মধ্যে ১১৮ জন জেলা ও ১৫৪ জন মহানগরের। তালিকায় খুলনায় মাদকদ্রব্য প্রবেশের বিভিন্ন রুট এবং কেনাবেচার স্থানগুলোর কথা তুলে ধরা হয়েছে। তালিকানুযায়ী, চোরাকারবারীরা সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা থেকে খুলনার চুকনগর অথবা আরেক সীমান্তবর্তী জেলা যশোর থেকে কেশবপুর হয়ে চুকনগর এবং অভয়নগর হয়ে ফুলতলায় বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ে আসছে।
অন্যদিকে, যশোরের বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনকেও মাদক বহনের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাকারবারীরা। এদিকে, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলাকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে ভারত থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য খুলনা শহরে নিয়ে আসা হচ্ছে।
এই চক্রের সদস্যরা সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করে সুকৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিবহণ করছে। শহরের জিরো পয়েন্ট ও খানজাহান আলী থানাধীন পথের বাজার এলাকা এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলেও তালিকায় উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনে করে মাদকদ্রব্য দৌলতপুর ও খুলনা স্টেশনে পাচার হচ্ছে বলে জানা যায়। মাদক পাচারের কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও তালিকায় জানানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মালামালের সঙ্গে লুকিয়েও মাদক পাচার হচ্ছে।
এরপর বিভিন্ন স্তরের কারবারীদের হাত ঘুরে এসব মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই মাদকদ্রব্যসহ ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। কিন্তু আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে তারা অনেকেই আবার একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। খুলনা জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এছাড়া খালিশপুর থানা এলাকায় ৪৪টি, খুলনা সদর থানা এলাকায় ১৪টি, খানজাহান আলী থানা এলাকায় ১৪টি, লবণচরা থানা এলাকায় ১১টি, দৌলতপুর থানা এলাকায় ১০টি, আড়ংঘাটা থানা এলাকায় ৭টি, সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় ছয়টি এবং হরিণটানা থানা এলাকার তিনটি স্থানে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হওয়ার তথ্য ওই তালিকায় উঠে এসেছে।
তেরখাদা উপজেলার সাতটি, দাকোপ উপজেলার নয়টি, পাইকগাছা উপজেলার চারটি, কয়রা উপজেলার দুইটি গ্রামে, বটিয়াঘাটা উপজেলার দুটি গ্রামসহ তৎসংলগ্ন এলাকায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয়। তা ছাড়া, দিঘলিয়া উপজেলায় তিনটি এলাকায় এবং রূপসা উপজেলার তিনটি গ্রামসহ পাশের এলাকায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয় বলে জানা যায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনার উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে লোকবল কম রয়েছে। তারপরও তালিকা অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে তালিকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নাম আসায় সেভাবে অগ্রসর হতে পারছেন না তারা।