খুলনায় মহাসমারোহে উদযাপিত হচ্ছে রথযাত্রা উৎসব

0
966

চিন্ময় প্রসূন বিশ্বাস : বিশ্বব্যাপী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব রথযাত্রা। ব্যাকরণগতভাবে রথযাত্রা শব্দটি দুইটি মৌািলক শব্দের মিলিত রূপ – রথ + যাত্রা = রখযাত্রা। রথ শব্দের আভিধানিক অর্থ চক্রযুক্ত যান, প্রাচীন অশ্বাদি বাহিত যান বা প্রাচীন যুদ্ধ শকট বা হিন্বদু দেবতা জগন্নসাথদেবের বাহন। আর যাত্রা শব্দের অর্থ গমন বা বাহির হওয়া। অতএব রথযাত্রা বলতে রথের যাত্রা বা রথ সহকারে যাত্রা বলা যায় তবে স্বউদ্যোগে যাত্রা করা রথের পক্ষে সম্ভব নয় বলে দ্বিতীয় অর্থটিই বাস্তবতার অধিকতর নিকজবর্তী। রথের উপর দেবতার মূর্তি বসিয়ে চালিয়ে নিয়ে উৎসব পালন করা হয় বলেই এই উৎসবের নাম রথযাত্রা বলে ধারণা করা যায়।
পুরাণ, বিভিন্ন শাস্ত্র এবং অন্যান্য গ্রন্থে নানা ধরণের রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন ভবিষ্য পুরাণে সূর্যদেবের রথযাত্রা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর রথযাত্রা, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ এবং ভবিষ্যোত্তর পুরাণে বিষ্ণুর রথযাত্রা বর্ণিত হয়েছে।
রথ সাধারণত: অশ্বচালিত। আবার টাঙ্গা ( যার চমৎকার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে যাযাবরের দৃষ্টিপাতে ) এবং টমটমও ( ঢাকার গুলিস্তানে এখনো চালু) ঘোড়ায় টানা। তবে রথ এবং টাঙ্গা বা টমটমের মধ্যে আকৃতি, প্রকৃতি, ব্যবহার এবং আভিজাত্যে ব্যাপক পার্থক্য। দেবতা এবং রাজন্যবর্গের দৈনদ্দিন চলাচল ছাড়া প্রধানত: যুদ্ধের জন্যই রথ ব্যবহার হয়। গ্রীক পুরাণ, রামায়ণ এবং মহাভারতে যার প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। দৃষ্টিপাত (যাযাবর) এর একেবারে প্রথমেই কৃত্তিবাস খেকে উদ্ধৃতি পাওয়া যাচ্ছে –
রাবণ বসিল চড়ি পুষ্পক রথেতে, বিদ্যুতের সম গতি আকাশ পথেতে।
ডানা ছাড়াই আকাশ পথে বিদ্যুতের গতিতে চলার জন্য রাবণের ছিল পুষ্পক রথ। সীতাকে পঞ্চবটী বন থেকে হরণ করে এই রথে উঠিয়েই তিনি আকাশপথে নিয়ে গিয়েছিলেন লঙ্কায় অশোকবনে। শেযের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “ মনে হয় অজ¯্র মৃতুরে পার হয়ে আসিলাম/ আজি নব প্রভাতের শিখর চূড়ায়/ রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়/ আমার পুরানো নাম — ” অর্থ্যাৎ রথ গতির প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের রচনায় আরো পাওয়া যাচ্ছে – “ রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম/ রথ ভাবে ’ আমি দেব’, পথ ভাবে ’ আমি’/ মূর্তি ভাবে ’ আমি দেব’/ হাসে অন্তর্যামী ” ( ভক্তিভাজন)। বাণীটি অত্যন্ত স্পষ্ট – মূর্তি বা রথ কোনটিই নয়, ঈশ্বরই আসল উপাস্য।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনে রথের নাম ছিল কপিধ্বজ যার সারথি ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই। গ্রীক পুরাণে সূর্যের দেবতা এ্যাপোলা তাঁর সাদা ঘোড়ার রথে জড়ে অলিম্পাস পর্বত থেকে পৃথিবী পরিক্রমায় বেরোতেন। তখনই দিনের শুরু হতো। বিশ্বভ্রমণ শেষে তিনি যখন ফিরে যেতেন নিজ আবাসে তখনই নেমে আসতো সন্ধ্যা। তাঁর সাদা ঘোড়াদের কেশরের ঝাঁকুনি থেকে যে কণা ঝরে পড়তো সেটাই সূর্যরশ্মি বলে গ্রীকদের বিশ্বাস। অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্বখ্যাত ছবি বেন হার -এ আছে সাদা এবং কালো ঘোড়ায় টানা দু’টি রথের দ্বৈরথের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য যেখানে সাদা ঘোড়ার রথ চালনা করেছেন ছাবির নায়ক চার্লটন হেসটন আর কালো ঘোড়ার রথ চালিয়েছেন স্টিফেন বয়েড। দু’জনেই বিশ্বখ্যাত অসাধারণ অভিনেতা। এক ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহাবীর কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গিয়োিছল।
বর্তমানে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সাথে এই উৎসবটির নাম ফঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ব্যুৎপত্তিগতভাবে জগন্ন্থ শব্দটি দুইটি মৌলিক শব্দের যৌগিক রূপ – জগত + নাথ = জগত অর্থ পৃথিবী আর নাথ অর্থ প্রভু বা অথীশ্বর। অর্থ্যাৎ জগন্নাথ শব্দের অর্থ জগতের প্রভু বা জগতের অধীশ্বর। ওড়িয়া ভাষায় জন্নআথকে জসবন্ধু ( জগতের বন্ধু)ও বলা হয়। রথযাত্রার ১৫ দিন আগে পূর্ণিমার দিনে  রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় তবে সর্বাধিক প্রচলিত, জনপ্রিয় এবং জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান রথযাত্রাই।
জগন্ন্থদেবের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা ধরণের পৌরাণিক এবং অন্যান্য উপাখ্যান প্রচলিত অঅছে। অনেকে মনে করেন যে একসময় উড়িষ্যায় বৃক্ষপূজারী শবর গোত্রের বসবাস ছিল। তারা তাদের ঈশ্বরকে জগন্ত নামে অভিহিত করতেন। এই জগন্ত শব্দ তেকেই জগন্নাথ নামের উৎপত্তি। কারো বিম্বাস যে জগন্নাথ হলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার। প্রায় সমস্ত হিন্দু দেবদেবীর মনুষ্যাকৃতির শৈল্পিক রূপ আছে কিন্তু একমাত্র র্বতিক্রম জগন্নাথ। তাঁর কোন স্বাভাবিক মানুষের অবয়ব নেই্।
স্বন্দপুরাণের অন্তর্গত পুরুষোত্তম মাহাত্ম্য থেকে জানা যাচ্ছে যে সত্যযুগে ইন্দ্রদ্যু¤œ নামে একজন চান্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। এক তীর্থযাত্রীর কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে মহা ঈশ্বর নীলমাধবের পূজা হচ্ছে নীলাচলে ( প্রাচীন উড়িষ্যার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র রাজ্য)। বিস্তারিত জানার জন্য তিনি স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিদ্যাপতি এবং রাজপুরোহিতকে পাঠালেন। শবররাজ বিশ্ববসুর সহযোগিতায তারা দেখতে পান যে মহানন্দী নদীর তীরে নীলমাধবের পুজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজধানী অবন্তীতে ফিরে বিদ্যাপতি রাজাকে সবকিছু জানালেন। স্বচক্ষে দেখার জন্য বিদ্যাপতি, পুরোহিত এবং অন্যান্য অনুসারীদের নিয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যু¤œ নিজেই যাত্রা করলেন কিন্তু নদীর তীরে গিয়ে আর নীলমাধবের দেখা পাওয়া গেল না।
বিষ্ণুপুরাণ থেকে জানা যাচ্ছে যে অবতার হিসাবে জীবনাবসানের পর শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই সময়ে কয়েজন ধার্মিক ব্যক্তি সেই গেহাবশেষ একটি পাত্রে সংরক্ষণ করেন। ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যু¤œ জগন্ন্াথদেবের কাঠের মূর্তি তৈরী করার জন্য দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে নিয়োগ দিলেন। বিশ্বকর্মঅর সহকারী ছিলেন একন ব্রাহ্মণ কারিগর। অনেকে বিশ্বাস করেনন যে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুই বিশ্বকর্মার ছদ্মবেশে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন তবে তিনি একটি শর্ত আরোপ করেন যে মূর্তি নির্মাণ হবে রুদ্ধদ্বার কক্ষে এবং কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন ব্যাঘাত ঘটানো যাবেনা। রাজা ইন্দ্রদ্যু¤œ সানন্দে এই শর্তে সম্মত হলেন কিন্তু কৌতূহল সম্বরণ করতে না পেরে ১৫ দিন পরে তিনি নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখার জন্য বিশ্বকর্মর কর্মস্থলের রুদ্ধদ্বারের সামনে উপস্থিত হলেন। তখন পর্যন্ত মূর্তি প্রায় অর্ধনির্মিত কিন্তু শর্তভঙ্গের কারণে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ রেখে বিশ্বকর্মা চলে গেলেন। জগন্ন্াথদেবের অত্যন্ত কুৎসিতদর্শন এবং কোমর পর্যন্ত হাত পা বিহীন এই মূর্তিই সর্বত্র প্রচলিত।
বৌদ্ধধর্মেও জগন্ন্াথদেবের অনেক অনুসারী। নমো জগন্ন্াথ বুদ্ধায়ঃ – এই মন্ত্র পাঠ করে তারা জগন্ন্াথদেবের পূজা করেন। তাঁদের মতে জগন্ন্াথ,বলভদ্র এবং সুভদ্রা একত্রে বুদ্ধ – সংঘ – ধম্ম এই তিন বাণীর প্রতিমূর্তি। বৌদ্ধ ধর্মের একাংশ বিশ্বস করেন যে ভগবান বুদ্ধের দন্তাবশেষ জগন্ন্াথদেবের উদরের অভ্যন্তরে সংরক্সিত আছে এবং এমন দাবী করেন যে জগন্ন্াথদেবের রথযাত্রা ভগবান বুদ্ধের রথযাত্রার মতই। জৈনরা বিশ্বাস করেন যে জিনানাথ শব্দ থেকেই জগন্ন্াথ শব্দটির উৎপত্তি এবং জগন্ন্াথমূর্তির সাথে প্রাচীন জৈন মূর্তির যথেষ্ট সাদৃশ্য বিদ্যামান। শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকও জগন্ন্াথদেবের দর্শন পাওয়অর জন্য ১৫০৬ সালে পুরীতে তীর্থযাত্রা করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
একটি জনপ্রিয় ওড়িয়া উপাখ্যান কাঞ্চি বিজয় থেকে জানা যাচ্ছে যে কাঞ্চির রাজকুমারী পুরীর রাজা গজপতির বাগদত্তা ছিলেন। কিন্তু রথযাত্রা উৎসরেবর সময় জগন্ন্াথ,বলভদ্র এবং সুভদ্রার মূর্তির সামনে ঝাড়ু হাতে গজপতিকে রাস্তার ধূলা পরিষ্কার করতে দেখে রাজকুমারী অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। রাস্তা ঝাাঁট দেয়ার কাজটিকে একজন রাজার জন্য অসম্মানজনক মনে করে তিনি সেই বিবাহ বাতিল করে দিলেন। অপমানিত গজপতি পুরুষোত্তম দেব প্রতিশোধস্পৃহায় কাঞ্চি আক্রমণ করলেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন। পাজিত রাজা আরাধনা করলেন জগন্ন্াথদেবের। তাঁর প্রার্থনায তুষ্ট হয়ে জগন্ন্াথ এবং বলভদ্র পরবর্তী অভিযানে রাজাকে সহযোাগিতা করলেন। ব্রহ্মপুরাণ এবং স্কন্দপুরাণে রথযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। রামায়ণের উত্তরকান্ডে জগন্ন্াথদেবের পূজা করার জন্য বিভীষণকে উপদেশ দিয়েছেন রামচন্দ্র।
দুর্গা ছাড়া আর সমস্ত হিন্দু দেবদেবীর পুজা হয় একক মূর্তিতে। ব্যতিক্রম শুধু জগন্ন্াথদেব। জগন্ন্াথদেবের পূজা হয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলভদ্র এবং ভগ্নী সুভদ্রার সাথে একত্রে। আর এই ত্রিমূর্তির সাথে থাকে সুদর্শন বক্র। সুভদ্রাকে অনেকে দুর্গার ভুবনেশ্বরী প্রতিরূপ বলেও মনে করেন। চারমূত্যিও এই অধিষ্ঠানকে বলা হয় চতুর্ধা। অন্য দেবদেবীদের তুলনায় জগন্ন্াথদেবের আরো এশটি দৃশ্যমান ব্যতিক্রম আছে। কালী ছাড়া অন্য সব দেবদেবীর মূর্তি অত্যন্ত সুদর্শন কিন্তু জগন্ন্াথদেবের মূর্তি অত্যন্ত কুৎসিত। ৬ ফুট লম্বা, বর্গাকার মাথা তবে ঘাড় নেই, পা নেই, কাঠের খুঁটির মত হাত, গায়ের রং কালো। চলৎশক্তিরহিত এই মূর্তির কারণেই হয়তো ঠুঁটো জগন্ন্াথ প্রবাদটির উদ্ভব। বলভদ্রের উচ্চতাও ৬ ফুট, মুখমন্ডল সাদা। ৫ ফুট উঁচু সুভদ্রার রং হলুদ। মূর্তি গুলি সাধারণতঃ নিম কাঠের তৈরী কারণ ভবিষ্যপুরাণে নিম গাছকে সবচেয়ে উপকারী এবং কার্যকর বৃক্ষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আরো একটি কারণ হতে পারে যে নিম কাঠে ঘুণ ধরার সম্ভাবানা কম বলে দীর্ঘস্থায়ী এবং বরাবার নির্মাণের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায়। আকৃতিগত দিক ছাড়াও জগন্ন্াথদেবের পূজার পদ্ধতিও ব্যতিক্রমী।
এই উৎসবের অপরিহার্য অনুষঙ্গ রথ। জগন্ন্াথদেবের রথের নাম নন্দীঘোষ। ৭ ফুট ব্যাসের ১৬ টি চাকা অর দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতায় ৪৫ ফুট বর্গাকৃতির। উজ্জ্বল লাল এবং হলুদ বস্ত্রাবৃত। জগন্ন্াথদেবকে পীতাম্বর নামেও অভিহিত করা হয়। বলভদ্রের রথের নাম তালধ্বজ। একটি তালগাছ পতাকাদন্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয় বলেই হয়তো এই নাম। ৭ ফুট ব্যাসের ১৪ টি চাকা আর উচ্চতায় ৪৪ ফুট। লাল এবং নীল বস্ত্রে আবৃত। সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন অর্থ্যাৎ অহঙ্কার বিনাশকারী। ৭ ফুট ব্যাসের ১২ টি চাকা অর উচ্চতায় ৪৩ ফুট। লাল এবং কালো বস্ত্রে আবৃত।তিনটি রথেই লাল রঙের উজ্জ্বল উপস্থিতি। শাস্ত্রীয় নির্দেশনা যেমনই হোক না কেন নানা ধরণের বাস্তব অসুবিধার কারণে বিশালাকৃতির রথ নির্মাণ সহজসাধ্য নয় বলে ক্ষুদ্রাকার রথেও উৎসবের কোন অঙ্গহানি হয় না। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গাতে বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া এবং নবমী তিথিতে রথযাত্রা উদযাপিত হয়। সময় নির্ধারিত তবে চান্দ্রমাস অনুসরণের কারণে তারিখ প্রতি বছরই পরিবর্তিত হয়। এবছর এবং পূর্ববর্তী তিন বছরের রথযাত্রার সময়টি দেখে নেয়া যেতে পারে।
বঙ্গাব্দ দিন ও মাস ইংরেজী বর্ষ
দিন ও মাস
১৪২২ ৩ শ্রাবণ ১৮ জুলাই ২০১৫
১৪২৩ ২২ আষাঢ় ৬ জুলাই ২০১৬
১৪২৪ ২২ আষাঢ় ২৫ জুন ২০১৭
১৪২৫ ৩০ আষাঢ় ১৪ জুলাই ২০১৫

প্রথম দিনে অর্থ্যাৎ দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্ন্াথ, বলভদ্র, এবং সুদর্শন চক্রের রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধান মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে। আটদিন পরে নবমীল দিনে আবার তাঁদের ফিরিয়ে আনা হয় মূল মন্দিরে যাকে বলা হয় উল্টোরথ। রথ সাধারণতঃ ঘোড়ায় চানা হলেও রথযাত্রায় হাজার হাজার ভক্ত নিজেরাই রথ েেন নিয়ে যান। রথের দড়ি ধরে টানার সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্য, আনন্দ এবঙ পুণ্যের বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়। তবে ভক্তির উচ্ছ্বাসে হুড়োহুড়ির কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটে। এমনকি পদদলিত হয়ে মৃত্যুর তথ্যও বিরল নয়।
রথযাত্রার মূল উৎসব পালিত হয় ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী শহর পুরীতে। পুরীর মন্দির পৃথিবীর বৃহত্তম জগন্নাথ মন্দির। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১০৮ টি বড় শহরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় রথযাত্রা। এই উৎসবকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার মূল কৃতিত্ব ইসকন ( ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাশনেস) এর। ইসকনের রথ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং কোন কোন জায়গায় অসাধারণ কারিগরি দক্ষতায় নির্মিত। কখনো দমকলের সুউচ্চ মইয়ের মত যা প্রয়োজনে তিন ভাঁজ করে নামিয়েও আনা যায়।
বাংলাদেশে রথযাত্রার ইতিহাস সুপ্রাচীন। পুরানো ঢাকায় অত্যন্ত জাঁককমক সহকারে রথযাত্রা উদযাপিত হতো এবং এখনো হয়। ঢাকার পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জের ধামরাইেেয যশোমাধবের রথযাত্রাও অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ। যশোমাধবের মন্দিরে উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সমযে সাটুরিয়ার বলিয়াদীর জমিদাররা ৬০ ফুট উঁচু যে রথ নির্মাণ করেছিলেন একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী সেটা পুড়িয়ে দেয়। তিনতলাবিশিষ্ট এই রথটি টানার জন্য ২৭ মণ পাটের দড়ি ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে নূতনভাবে নির্মিত রথে এই উৎসব উদযাপন করা হয়। বিশাল বলিয়াদী জমিদারবাড়ী বর্তমানে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন যা বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এছাড়া গাজীপুরের মাণিক্যমাধবের রথযাত্রা, কিশোরগঞ্জের ভেগবেতালের রথযাত্রা, কুমিল্লার মহরাজ বাহাদুরের রথযাত্রা, যশোরের বারইখালি ও বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের রথযাত্রা, রংপুরের আদিতমারী উপজেলার কামারপাড়া রথযাত্রা এবং চট্টপগ্রামের তুলসীধামের রথযাত্রায় বিশাল জনমসমাগম হয়। বাগেরহাটের নিকটবর্তী যাত্রাপুরের রথযাত্রাও দক্ষিণাঞ্চলে প্রসিদ্ধ। সম্ভবত: রথযাত্রার নামেই জায়গার নাম হয়েছে যাত্রাপুর।
রথযাত্রা উপলক্ষ্যে হিন্দুদের মধ্যে দু’টি সংস্কার বিদ্যমান। দিনের পূর্বাহ্নে মেঘের গর্জন শোনা গেলে আগাম বর্ষা আসে আর দিনের পরভাগে মেঘ ডাকলে বর্ষার আগমন বিলম্বিত হয়। এই দিন কলাগাছ রোপণ করলে বেশী কলা ধরে। তবে রথযাত্রা বর্ষাকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে এই সময়ে বৃক্ষরোপণের একটি প্রথা প্রচলিত আছে যা বর্তমানে সকল ধর্মাবলম্বীর মধ্যেই প্রবাহিত।
সাধারণ জনগণের পাশাপাশি স্থানীয় নেতৃবর্গ, জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এবং সমাজের সর্বস্তরেরর মানুষ রথযাত্রায় অংশ নেন্ এভাবেই রথযাত্রা ধর্শীয় অনুষ্ঠানের সীমানা অতিক্রম করে সম্প্রীতির অনুষ্ঠান হিসাবে পরিচিতি লাভ কর্ েরথযাত্রা শুধুমাত্র দেবতাদের এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে যাওয়া আর ফিরে আসার নয়। প্রকৃত অর্থে এটি মানবতা, শান্তি এবং সম্প্রীতির পথে যাত্রা।