খুলনায় ব্যাংক লেজারে পাট আছে অথচ গুদামে পাট নেই

0
1060

ফকির শহিদুল ইসলামঃ
কথায় আছে কর্তা বাবুর গাই(গরু) কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই । এমনই অবস্থা খুলনার দৌলতপুর কেন্দ্রীক কাঁচাপাট রপ্তানীর নামে সোনালী ব্যাংকের ঋণের টাকার ক্রয়কৃত পাট গুদামে নেই । যে সকল প্রতিষ্ঠান কাঁচাপাট রপ্তানীর নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাদের নেই পাট রপ্তানী নেই তাদের গুদামে ঋণের টাকার পাট । এখানে প্রশ্ন জাগে তাহলে পাট গেলো কোথায় । ভূতে নিয়েছে পাট । ব্যাংকের ঋণের টাকার ক্রয়কৃত পাট ভুতে নিলেও আবার চলছে সরকার দলীয় পাট ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ সুবিধা দিতে লুটপাটের এক নতুন আয়োজন । আর এ ব্যাংক লুটের আয়োজনের জন্য করা হয়েছে নতুন ঋণ নীতিমালা । নতুন ঋণ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে মুলত রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার দলীয় পাট ব্যাবসায়ীদের নতুন করে হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য ঋণ নীতিমালা প্রনয়ন করা হয়েছে ।
মূলত খুলনার দৌলতপুরের দলীয় পাট ব্যবসায়ীদের তদবিরে এই সুবিধা প্রণয়ন করা হয়েছে । কারন দেশের কাঁচাপাট রপ্তানীর সিংহভাগ পাট রপ্তানী হয় দৌলতপুর কেন্দ্রীক পাট ব্যাবসায়ীদের মাধ্যমে । সে কারনে সোনালী ব্যাংকের পাট খাতের ঋণখেলাপিদের জন্য এই নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। অথচ গেল বছর রপ্তানীকারকদের কেন ঋণখেলাপি ঘোষনা করা হবে না” এমন চুড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছিল । কিন্ত নোটিশ দেয়া হয়েছে তারাই নতুন নীতিমালার ফের ঋণ সুবিধা ভোগ করবেন। করবেন সোনালী ব্যাংকের পাট খাতের দেয়া ঋণের টাকা লুটপাট । আর এ ব্যাংক হরিলুটের নিতিমালায় ঋণখেলাপিদের আগের ঋণ আদায় না করে তাদের ঋণ ব্লক (জব্দ) সুবিধা দিয়ে নতুন করে ঋণদানের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলা হয়েছে । রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পাট খাতের ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই এ চার দফা নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রথম নীতিমালায় ব্লক টাকার বিপরীতে সহয়াক জামানত দেবার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ঋণের মাত্র ১০-২০শতাংশ সহায়ক জামানত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যা ব্যাংকিং নিয়ম নীতির পরিপন্থী। ফলে রাষ্ট্রায়াত্ব সোঁনালী,রুপালী,অগ্রনী ও জনতা ব্যাংকের পাট রফতানি খাতে বিনিয়োগকৃত প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ভবিষ্যত অনিশ্চিত । এ বিপুল পরিমান ঋণের টাকা অনাদায়ী হয়ে কু-ঋণে রুপান্তিত হবে । জনগনের আমানতের টাকা লুটপাটের এ মহাকর্মসুচি বাস্তবায়নে এখন চলছে বাংলাদেশ জুট এ্যাসোসিয়েশনের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন । নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবেন তারা হবেন নতুন করে ব্যাংক ঋণের সুবিধা ।

পাট সংশ্লিষ্টরা জানায়, খুলনাকে ঘিরে পাট বাণিজ্যের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেও টিকে ছিলেন এখানকার ভালো কাঁচাপাট ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী সময়ে খুলনার পাট ব্যবসায় ছন্দপতন হয়েছে। প্রভাবশালী মহলের তদবির ও চাপের কারণে ২০০৮-১৬ সাল পর্যন্ত ভুঁইফোড় অনেক ব্যবসায়ীকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের ঢালাওভাবে ঋণ দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সোনালী ব্যাংক। ঋণ নেয়ার পর বেশির ভাগ গ্রাহকই পরে ব্যাংকের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি। যে ১১৩ পাট ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়া হয়েছিল, তাদের ১০৮ জনের ঋণই এখন খেলাপি। খুলনায় সোনালী ব্যাংকের ছয়টি শাখা থেকে দেয়া হয় প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে খুলনার করপোরেট শাখা, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা ও স্যার ইকবাল রোড শাখা ও খালিশপুর শাখার বিতরণকৃত ঋণের প্রায় শতভাগই খেলাপি। সোনালী ব্যাংকের পাট খাতে বিনিয়োগের এক হাজার আটশত কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা এবং জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা প্রায় শতভাগই খেলাপি হওয়া সত্বেও রাজনৈতিক তদবিরে ১০ বছরের জন্য তাদের ঋণ ব্লক করে আবার নতুন ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ।

সিসি প্লেজ, সিসি হাইপো, পিসিসি ও ব্লক হিসাবের বিপরীতে কাঁচা পাট রফতানিতে এ ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে সিসি প্লেজ হিসাবের বিপরীতে। গুদামে মজুদ থাকা পাট জামানত রেখে প্লেজ ঋণ দেয়া হয়। ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত না পেলেও গুদামের পাট বিক্রি করে দিয়েছেন ঋণখেলাপিরা। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্কারী ব্যবসায়ীদেরই আবারো নতুন করে ঋণ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সোনালী ব্যাংক।খুলনার দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা থেকে ২০ জন গ্রাহক ঋণ নিয়েছেন ৩২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩১৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা ৯৮ দশমিক ৮৮ শতাংশই এখন ঋণ খেলাপি। এসব ঋণ খেলাপির পাটের গুদামে পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ খেলাপির পাটের গুদাম পরিদর্শনের ভিত্তিতে তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনা কার্যালয়ের প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে । প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংকের দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা থেকে ঋণ নেয়া কোনো ব্যবসায়ীর গুদামেই শতভাগ পাট নেই। পাটগুদামের অস্তিত্ব নেই, এমন পাট গুদামও পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শক দল।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সোনালী ব্যাংক খুলনার দৌলতপুর শাখার গ্রাহক মেসার্স আজাদ ব্রাদার্সের গুদামে পাট আছে ২ শতাংশ। মেসার্স অনিক জুট ইন্টারন্যাশনালে ২-৩ শতাংশ, মেসার্স এফএম জুট সাপ্লাইয়ে ৫, মেসার্স অগ্রণী পাট সংস্থায় ৫, মেসার্স প্রান্তিক জুট ফাইবার্সে ৫-১০, আলীফ জুট ট্রেডিংয়ে ৫-১০ ও মেসার্স হাফিজ অ্যান্ড ব্রাদার্সে ১০ শতাংশ পাট রয়েছে। ১০-১৫ শতাংশ পাট পাওয়া গেছে মেসার্স সানরাইজ ইন্টারন্যাশনালে। একইভাবে বিএম জুট গার্ডেনে ১৫-২০ শতাংশ, মেসার্স আবীর জুট ট্রেডিংয়ে ১৫, মেসার্স মনোয়ারা জুট ফাইবার্সে ৬৫, মেসার্স কোয়ালিটি জুট সাপ্লায়ার্সে ২০, মেসার্স রিফা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালে ২০-২৫, মেসার্স আলহামদুলিল্লাহ জুট ট্রেডিংয়ে ২০, মেসার্স সিরাজুল ইসলামে ২৫ ও মেসার্স এমডি শরীফ মোল্যায় ১৫-২০ শতাংশ পাট পেয়েছে পরিদর্শক দল। পরিদর্শক দল সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পাট পেয়েছে এসআর জুট ট্রেডিংয়ে।তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল ঋণখেলাপি মেসার্স খালিদ জুট ট্রেডিংয়ের কোনো গুদামের অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্লেজ ঋণের বিপরীতে কোনো গুদামের কোন অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়নি। যদিও ২০১৭ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের বকেয়া ঋণ ছিল ৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
সোনালী ব্যাংকের খালিশপুর শাখা থেকে ১৩জন পাট ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১২ পাট ব্যবসায়ীই বর্তমানে খেলাপি। ঋণখেলাপিদের পাটের গুদামে গত বছর পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিদর্শনকালে কেবল জেমস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গুদামে ৫০ শতাংশ পাট পেয়েছে পরিদর্শক দল। অন্য গ্রাহকদের মধ্যে মেসার্স মক্কা জুট ট্রেডিংয়ে ৪ শতাংশ, আমীর জুট ট্রেডার্সে ৪, পদ্মা এন্টারপ্রাইজে ৫, বিসমিল্লাহ জুট ট্রেডিংয়ে ৫, এসবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালে ৫ ও মদিনা জুট ট্রেডিংয়ে ৮ শতাংশ পাট পাওয়া গেছে। মেসার্স আরেফিন ট্রেডার্সে ১০ শতাংশ, সীমা ট্রেডার্সে ১৭, মেসার্স পাপেন জুট ট্রেডিংয়ে ২০, মেসার্স বাবুল জুট ট্রেডিংয়ে ২৫ ও মেসার্স এআর জুট ট্রেডিংয়ে ৪৫ শতাংশ পাট খুঁজে পেয়েছে পরিদর্শক দল।সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, খুলনার ঋণখেলাপি সব পাট ব্যবসায়ীরই গুদামের পরিস্থিতি একই। ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার জন্য রফতানি করতে না পারাকে দায়ী করছেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রফতানি করতে না পারলে ঋণখেলাপিদের গুদামে পাট থাকার কথা। কিন্তু কোনো ঋণখেলাপির গুদামেই পর্যাপ্ত পরিমান পাট নেই। অথচ সংশ্লিষ্ঠ ব্যাংকের লেজার বলছে ঋণ গ্রহিতারা খেলাপি হলেও তাদের গুদামে পর্যাপ্ত পরিমান পাট রয়েছে ।