খুলনায় কৌশলে চলছে বিড়ি- সিগারেটের প্রচারণা

0
608

নিজস্ব প্রতিবেদক
আইন করে সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যের সব ধরনের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হলেও খুলনায় থেমে নেই প্রচারণা। ভিন্ন কৌশলে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বাহারী এসব প্রচারণার মাধ্যমে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে ধূমপানে আগ্রহী করে তুলছে। জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা বলছেন, সম্পূর্ণ আইন অমান্য করে ভিন্ন আঙ্গিকে ধূমপানের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। যা দন্ডনীয় অপরাধ।
সরেজমিনে খুলনার আদলত পাড়া, নিউ মার্কেট, পিকচার প্যালেস, খালিশপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সিগারেট কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের স্টিকার, লিফলেট, আকর্ষণীয় লাইটার, টি-শার্টসহ বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে চায়ের দোকানে চায়ের কাপ উপহার দিচ্ছে। এসব চায়ের কাপে নির্দিষ্ট সিগারেটের লোগো দেওয়া আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা এখানে বেতনভিক্তিক কাজ করছি। খুলনা নগরীতে প্রায় প্রতিটি কোম্পানির মোট ৫০ জন প্রতিনিধি কাজ করছে। প্রতিদিন একেকজনকে ৮০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, মার্কেটে সিগারেটের চাহিদা বাড়ানোর জন্য অনেক কৌশল নিতে হয়। কোম্পানির মাসিক টার্গেট পুরণ করতে হয়।‘মার্লবোরো ভাল সিগারেট হলেও বেনসন বা অন্য সিগারেটগুলোর মতো বাংলাদেশে এটা চলে না। মার্লবোরোর মার্কেট বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কৌশলে প্রচারণা চালাতে হয়।
সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল এলাকায় দেখা গেছে আরেক চিত্র। ছোট একটি সিগারেটের বাক্স নিয়ে ঘুরছে রাজু নামের এক কিশোর।পুরো বক্সটি সিগারেট দিয়ে সাজানো। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট সে বিক্রি করে।
রাজু জানায়,বেনসন সিগারেট বেশি বিক্রয় করায় বেনসন কোম্পানি তাকে এই বাক্স দিয়েছে। তবে শর্ত রয়েছে, বেনসন ছাড়া অন্য কোনও সিগারেট সে বিক্রি করতে পারবে না।
নগরীর নতুন রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানগুলোতে দেখা গেছে, সিগারেট কোম্পানিগুলোর ভিন্ন কৌশল। চায়ের কাপে সিগারেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন। দোকানি জানান, উইংস্টোন কোম্পানি থেকে কাপগুলো তাকে ফ্রিতে দেওয়া হয়েছে। এগুলোতে করে কাস্টমারদের চা দিলেই নাকি ওদের লাভ।
প্রচারণা কৌশল হিসেবে খুলনা নগরীর প্রায় সব এলাকায় দেখা গেছে, খুচরা সিগারেট বিক্রেতারা সুদৃশ্য শোকেজে নিয়ে সিগারেট বিক্রি করছে। এসকল দামি ও সুদৃশ্য শোকেজগুলো কোম্পানির কাছ থেকে বিনামূল্যে পেয়েছে ,যার প্রতিটির দাম ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা।
খালিশপুর চিত্রালী বাজারের সিগারেট বিক্রেতা দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমার শোকেজটি দিয়েছে গোল্ড-লিফ ও বেনসন কোম্পানি থেকে। কোনও কিছু ভেঙে গেলে বা নষ্ট হলে তারাই এসে ঠিক করে দিয়ে যায়।’ সবাইকে এই বক্সগুলো দেয়া হয় না বলে জানিয়েছেন তিনি। কারা বক্স পাবেন, লোকেশন ও দৈনিক বিক্রির ওপর নির্ভর করে সেটা নির্ধারণ করা হয।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে প্রায় ৪ হাজার মুদি এবং টি স্টলের লাইসেন্স রয়েছে। তবে লাইসেন্সবিহীন রয়েছে প্রায় ৮ হাজার। এ সকল দোকান বা স্টলে মূল্য তালিকার নামে দেয়া হচ্ছে সিগারেটের বিজ্ঞাপন। এক্ষেত্রে প্রশাসন ও জেলা টাস্কফোর্স কমিটির নীরবতাকেই দায়ি করছেন খুলনার নাগরিক সমাজ। ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য (ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধন) ২০১৩ এর ৫ ধারা’র (ক) বলা হয়েছে, প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না; এবং এ আইনের একই ধারার (ক) বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে (পয়েন্ট অব সেল্স) যে কোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না। কিন্তু কোম্পানিগুলো এ আইন অমান্য করে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করছে নানা কৌশল। যা বেআইনী। অনেকগুলো সিগারেট এর নাম এবং দাম সম্বলিত ফেস্টুন তৈরি, স্টিকার তৈরি করছে এবং ন্যায্য মূল্যে সিগারেট বিক্রির নিশ্চয়তা দিয়ে তৈরি করছেন প্যানা ফেস্টুন। এ ফেস্টুন বা স্টিকার দোকানের সামনে এবং প্রকাশ্যে সাজিয়ে রাখছে কোম্পানি। যাতে দূর থেকে ধূমপানের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই কৌশলে কোম্পানি তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে, অনেকগুলো সিগারেটের খালি মোড়ক সাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। রয়েছে কোম্পানির নিজস্ব রং এবং বিশেষভাবে তৈরি স্টল এবং শোকেস। প্রচারণায় এমন ফেস্টুনে নিশ্চিত করা হয়ে থাকে যে, সেখানে সিগারেট বিক্রয় হয় এবং কোন কোন কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের সিগারেট সেখানে রয়েছে।
নগরীর হাজী মহসিন রোড এলাকার স্টলের মো. শোভন জানান, কোম্পানি থেকে এসব ব্যবস্থা করে। আর বিজ্ঞাপন না দিলে মানুষ জানবে কি করে, এখানে সিগারেট রয়েছে। সিগারেটের মূল্য তালিকা থাকা মানে সেখানে সিগারেট পাওয়া যায়।
নিউমার্কেট এলাকার মুদি দোকানদার রিপন জানান, কোম্পানির লোক টাঙিয়ে দিলে কি করবো। খারাপ কি। এ ফেস্টুনে লেখা থাকে ‘ন্যায্য মূল্যে সিগারেট বিক্রি হয়’। আর মুদি দোকানে এতো মালামাল থাকে সবের তালিকা করা সম্ভব হয় না।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব লোকমান হাকিম জানান, প্রকাশ্যে ধূমপান এবং বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। সে কারণে সুকৌশলে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। একমাত্র প্রশাসনই পারে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার কো-অর্ডিনেটর এড. মো. মোমিনুল ইসলাম জানান, আইনের সাথে এক ধরনের প্রতারণা করছে এ কোম্পানিগুলো। আমি মনে করি জেলা প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে এসব হচ্ছে। এক্ষেত্রে জেলা টাস্কফোর্স কমিটির নীরবতাও রয়েছে।
খুলনা জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য এবং বেসরকারি সংস্থা সিয়ামের নির্বাহী পরিচালক মাসুম বিল্লাহ জানান, মোবাইল কোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং কোম্পানিগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
খুলনা জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং খুলনার সিভিল সার্জন ডাঃ এএসএম আব্দুর রাজ্জাক জানান, আমরা জেলা প্রশাসককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জন্য বলেছি। আগামী মাসের প্রথম দিকে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবো। জেলা টাস্কফোর্স কমিটির কোনো দুর্বলতা নেই। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে হওয়ায় সিটি কর্পোরেশনেরওতো দায়িত্ব রয়েছে এ বিষয়ে নজর দেয়ার।