খুমেক হাসপাতালে ফের অভিযানে ক্লিনিক মালিকসহ ১৩ দালাল আটক

0
940

#র‌্যাবের অভিযানের পরও বন্ধ হয়নি দালালদের তৎপরতা

কামরুল হোসেন মনি: বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ দোকানদারদের দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। এর মধ্যে হাসপাতালের বহিঃবিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও জরুরি বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ দোকানীদের দালালরা। তাদের কাছে অসহায় রোগীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

এ রকম অভিযোগের ভিত্তিতে কেএমপি’র ডিবি পুলিশের দুইটি টিম রোববার সকাল ১১টার পর থেকে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে হাসপাতালের সামনে অবস্থিত উদয়ন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারের মালিক এস এম সৈয়দ হোসেনসহ ১৩ জন আটক হয়। আটককৃত অন্যান্যরা হচ্ছেন আব্দুল আলীম, সোহেল, আরিফুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, তাপস রানা, মুরাদ খান, শামীম হোসের বুলু, ফরিদ শিকদার, আবুল কালাম, জিল্লাল মোল্লা, নাজিম উদ্দিন মোল্লা ও উজ্জ্বল দাস।
এর আগে একই হাসপাতালে র‌্যাব-৬ এর একটি টিম অভিযান চালিয়ে সুগন্ধা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সেলিমসহ ২২ জন দালালকে আটক করেছিলেন। ওই সময় র‌্যাব-৬ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিপিসি কমান্ডার মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের থেকে আসা অসহায় রোগিদের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ওই সব দালালরা বাইরে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তিনি তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন এই হাসপাতালকে ঘিরে প্রায় ৩শ’র মতো নারী-পুরুষ মিলে দালাল রয়েছে।
গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম কামরুল ইসলাম বলেন, খুলনার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় রোগীরা দালালদেল খপ্পরে পড়ে চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছেন। এ সব অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে আটক করা হয়েছে।
খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এ এস এম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, সম্প্রতি খুমেক হাসপাতালে র‌্যাব-৬ এর অভিযানে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকসহ বহু দালাল আটক করেন। এর পরও দালাল নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে জনসচেতনতার লক্ষ্যে হাসপাতালে দালালদের হতে সাবধান লিখিত প্যানা আজ সোমবার টাঙানো হবে। এছাড়া সকাল ৮টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত দালালদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতার লক্ষ্যে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
গোয়েন্দার সূত্র মতে, হাসপাতালের কতিপয় ফ্রি সার্ভিস ও হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ওই সব দালালদে মদদ দিয়ে থাকেন। যার কারণে হাসপাতাল পুরোপুরি দালালমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ৭২টির মতো ওষুধের দোকান রয়েছে। এই সব দোকানের দালালরা দিনে রাতে ৫-৬ জনে ভাগ হয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সক্রিয় থাকে। খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। যে সব রোগীরা এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকেন তাদের অভিভাবকের কাছে ওই সব ওষুধ দোকানীদের দালালরা রোগীর ওয়ার্ডে গিয়ে ওষুধ বাকির নামে সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলে তাদের কার্ড ধরিয়ে দেন। যে সব রোগীরা গ্রামগঞ্জের বাসিন্দা তাদেরকে টার্গেট করে ওইসব দালালরা। ওই সব দোকানে রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ আনতে গেলে চিকিৎসকদের উল্লিখিত কোম্পানির ওষুধ না দিয়ে তাদের মনমতো (যে কোম্পানির ওষুধে লাভ বেশি) সে সব কোম্পানির ওষুধ ধরিয়ে দেন। এছাড়া দামও নেন অতিরিক্ত। ওই সময় রোগীর অভিভাবকরা তাড়াহুড়ো করে দামি ওষুধ বাকিতে কিনতে গেলে ওষুধ দোকানীরা দুইটির জায়গায় একটি দিয়ে দুইটির দাম খাতায় লিপিবদ্ধ করেন। ওষুধ দোকানীদের সাথে অনেক সময় এ সবের কারণে রোগীদের অভিভাবকদের কথা-কাটাকাটির ঘটনাও ঘটে।
অভিযোগে জানা গেছে, খুমেক হাসপাতালের সামনে উদয়ন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, বয়রাস্থ ডাক্তারপাড়া রোডস্থ সুগন্ধা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলপ গার্ডেনসহ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে যান। এর মধ্যে উদয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিয়োজিত দালাল রয়েছে পুরুষ মহিলা মিলে ২০-২৫ জনের মতো। মাঝে মধ্যে ওই সব দালালদের আটক করা হলেও পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের মধ্যে রয়েছে লিপি-১, লিপি-২, লিপি-৩, কাজল, জেসমিন, খোরশেদ, শোভা, আঁখি, মেহেরুন, খোদেজা, চুমকি, মনজিলা, রফিকুল, রুমা, রিতাসহ আরও অনেকে। এদের মধ্যে অনেকেই একাধিক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। আর বয়রাস্থ ডাক্তারপাড়া রোডস্থ সুগন্ধা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সেলিম ও হারুন দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে দালালদের মধ্যে রয়েছে খোদেজা, আনোয়ারা, বাবু, সেলিনা, মোর্শেদা ও ফরিদা, বিউটি, শাহিনা ও ইয়াসমিন, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জাহানারা ওই হাসপাতালের রোগীদের ভাগিয়ে আনে। ওই সব দালারা রোগীদের প্রতি টেস্টের জন্য ২৫ শতাংশ, সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসকরা বিভিন্ন টেস্ট অনুযায়ী পান ৬০-৮০ শতাংশ এবং বাকিটা মালিকরা নেন।
উল্লেখ্য, গত ২ অক্টোবর র‌্যাব-৬ এর একটি টিম খুমেক হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকসহ ২২ জনকে আটক করেন। এ সব দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা করেন। ওই সময় আটক দালালরা হচ্ছে লাইলী বেগম, রানু বেগম, ফরিদা বেগম, মমতাজ বেগম, নাছিমা বেগম, সুমি, সাপি, রমিনা বেগম, সালমা, সাবিনা বেগম, মুন্নী বেগম, কাজল, খাদিজা বেগম, ফাতেমা বেগম, স্বপ্না বেগম, ফরিদা বেগম, রুমা, রাবেয়া বেগম, ফাতেমা বেগম (২), মেহেরুন্নেছা, মোঃ রিপন ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মোঃ সেলিম শেখ। এদের মধ্যে বয়রাস্থ ডাক্তারপাড়া রোডস্থ সুগন্ধা ডায়গনস্টিক সেন্টার মালিক মোঃ সেলিম শেখকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাসহ ১৫ দিনের সাজা প্রদান করেন। এছাড়া রুমা নামে অপর এক দালালকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।