কয়রায় নতুন এলাকা প্লাবিত, পানিবন্ধি মানুষের দুর্ভোগ-সংকটে মানবেতর জীবন যাপন

0
266

ওবায়দুল কবির সম্রাট,কয়রাঃ

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে খুলনার কয়রায় উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে সাত থেকে আট ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। উচ্চ জোয়ারের তোড়ে কয়রায় বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২০টি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ভাঙা বাঁধ থেকে প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানি ঢুকে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।এতে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ২৭ মে সকালেন জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও বেঁড়িবাধ নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়।

এর আগে গত ২৬ মে বুধবার দিনের জোয়ারের পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে ও উপচে পড়ে প্লাবিত হয় কয়রা উপজেলার প্রায় ৪০ টি গ্রাম।স্থানীয় জনগণ বিকালে কয়েকটি পয়েন্টে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বেঁড়িবাধ আটকালেও ২৭ মে সকালের জোয়ারের তোড়ে আটকানো বেঁড়িবাধ সহ নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে দুর্গত এলাকার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।পানিতে ভেসে গেছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ পুকুর-জলাশয়ের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এতে উপজেলার মৎসজীবীরা প্রায় ১০কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে উপজেলা মৎস্য অফিস। পাশাপাশি দুর্গত এলাকার অধিকাংশ কাঁচা বাড়িঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির তোড়ে বিভিন্ন এলাকায় গ্রামীণ পাকা-কাঁচা সড়ক ভেঙে ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। অনেক এলাকায় ভেলা ও নৌকায় যোগাযোগ করতে হচ্ছে বানভাসি মানুষের।পানিবন্দি অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা উঁচু জায়গায় ও আশ্রায় কেন্দ্রে। তবে আশ্রয় নেওয়া পানিবন্দি এসব মানুষ দুর্ভোগ-সংকটে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবিলত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ অব্যাহত থাকার কথা জানালেও এখনও ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ বানভাসিদের অনেকের। বডবাড়ী গ্রামের আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া বিধবা রোকেয়া বলেন,আমাগের ঘর পানিতে ডুবি গেছে।‘বন্যার পানিতে হাবুডুবু খাইতাছি। কোনো অফিসার, চেয়ারম্যান মেম্বরেরা সাহায্য দিতে আসেনি।’‘আমরা কোনো সাহায্য না পাইয়া ২ দিন খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টে আছি। পবনা এলাকার গৃহবধূ জায়েদা বলেন, ‘হুনছি, বইন্না এহনো আয় নায়। হেইতেই এত পানি। জানি না বইন্নায় কী অইবে!’ দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আব্দুস সবুর গাজি বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই,এখন পানি বন্ধি ‘কাজ নাই, খাবার নাই। খুব দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছি।’ দুর্গতরা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। যখন জোয়ারের পানি বাড়ছে তখন অন্যত্র আশ্রয় নিতে হচ্ছে তাদের। তাদের দাবি এমন দুর্যোগে খাদ্য সহায়তা নয় টেকসই বেড়িবাঁধই বেশি প্রয়োজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজকে ধীরগতি ও কার্যকারী কোন পদক্ষেপ না থাকায় এলাকাবাসী দীর্ঘমেয়াদী জলাবন্ধতা থাকার আশঙ্কা করছেন। উপজেলার সবচেয়ে প্লাবিত মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এর হোগলার দুইটি, দশালিয়ার দুইটি, মঠবাড়ির দুইটি পয়েন্ট, মোট ৬ টি পয়েন্ট ভেঙে হোগলা, দশালিয়া, মঠবাড়ী, আটরা, গোবিন্দপুর, জয়পুর, শিমলারাইট, বাউলিয়া ঘাটা, মঠের ডাঙ্গা, সুতির কোনা, সুতির ধার, পোলাডাঙ্গার চক, মোড়লের চক, অন্তাবুনিয়া, দেয়াড়া সহ অন্তত ২১ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়েছে সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে শত শত একর জমির মৎস্য ঘের। আগামী ২৮ মে এলাকাবাসী কে সাথে নিয়ে ভেঙে যাওয়া স্থানগুলো আটকানোর চেষ্টা করবেন বলে চেয়ারমান জানান।

উত্তর বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান সর্দার নুরুল ইসলাম জানান গাতিরঘেরী হতে বীণাপাণি পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের চারটা স্থান ও পদ্মপুকুর এলাকার একটি স্থান দিয়ে লাগাতার পানি প্রবেশ করে হরিহরপুর পদ্মপুকুর গাতির ঘেরী বীণাপাণি সহ অন্তত ৭ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। এরমধ্যে কিছু মানুষ হরিহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পদ্মপুকুর কপোতাক্ষ স্কুলকাম সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে। দক্ষিণ বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান কবি শামসুর রহমান জানান:, আংটিহারা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এর প্রায় ১০০ মিটার ভেঙে লাগাতার জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় আংটিহারা, ঘড়িলাল, জোড়শিং, পাতাখালি, গোলখালী সহ ৫/৭ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আগেই কয়রায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের কারণে কয়রায় কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে সাত থেকে আট ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হওয়ায় ৬ টি পয়েন্ট ভেঙে ও ৩০ টি পয়েন্ট দিয়ে বেঁড়িবাধ উপছে উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। এতে লোকালয়ে পানি ঢুকে কয়েক অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের কাজ চলমান আছে।ভাল ভাবে সংস্কার করতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ।

এ বাঁধ আমরা অচিরেই সংস্কার করব।’ উপজেলা নির্বাহী অনিমেষ বিশ্বাস জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে ইতিমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি।এ ছাড়া দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা মজুত আছে। ইতি মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৪ টি ইউনিয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দের নিকট ইউনিয়ন প্রতি আড়াই টন চাউল ও নগদ ২৫ হাজার করে টাকা ক্ষতি গ্রস্ত মানুষের মাঝে বন্টন বন্টন দেয়া হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং পরিবারের তালিকা প্রস্তুতের কাজও শুরু করেছি।পর্যায়ক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বানভাসি অসহায় সব মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।