কেসিসি নির্বাচনী হালচাল; কেমন সিটি কর্পোরেশন চায় নগরবাসী

0
641

সাইমুম মোর্শেদ:

আধুনিক কুয়ালালামপুর অথবা সিঙ্গাপুর সিটি একদিনে গড়ে ওঠেনি।এর পেছনে শহরগুলোর শাসকদের ঘাম, শ্রম, নিষ্ঠা ও সততা জড়িত।তাই খুলনাকে আধুনিক, ডিজিটাল ও বসবাসের উপযোগি গ্রিন সিটিকে রুপান্তরের জন্য চাই তারুণ্য নির্ভর, আধুনিক, বিজ্ঞান মনস্ক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন মেয়র।নির্বাচনের আগে বাসযোগ্য নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিতে চান সব প্রার্থী।কিন্তু বাস্তবিক রুপ ধারণ করতে, নির্বাচিত হওয়ার পর উল্লিখিত বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিলে আপাত দৃষ্টিতে বাসযোগ্য খুলনা সিটি হিসেবে রুপ দেয়া সম্ভব।এখন দেখার বিষয় সিটি কর্পোরেশনে নগর পিতা নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মানতে তারা সচেষ্ট হবেন নাকি মেয়র নির্বাচিত হয়ে সব প্রতিশ্রুতি ভুলে সুবিধাবাদীর আচরণ করবেন।

খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি)-এর নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা হবে আগামী ৩১ মার্চ।এই নির্বাচনকে ঘিরে আগে থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছেন সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীরা।

এরই মধ্যে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নিয়ে শুরু হয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের জন্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তাই সিটি কর্পোরেশনে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী ও নির্বাচন অর্থবহ করতে অধিকাংশ দল প্রার্থী মনোনয়ন দিবেন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করার বিধান থাকলেও বাস্তবে তা আর অরাজনৈতিক হচ্ছেনা।আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং-গ্রুপিংয়ের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছেন।আর বিএনপির একাধিক প্রার্থী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিলেও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ায় তারা অনিশ্চয়তায় আছেন।প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরাও।

জানা যায়, কেসিসির(খুলনা সিটি কর্পোরেশন) সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০১৩ সালের ১৫ জুন।নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নাগরিক ফোরামের প্রার্থী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (আনারস প্রতীক) এক লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটির প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক এমপি পেয়েছিলেন এক লাখ ২০ হাজার ৫৮ ভোট। জাতীয় পার্টি সমর্থিত শফিকুল ইসলাম মধু (দোয়াত-কলম প্রতীক) জামানত হারিয়েছিলেন। তখন খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে ভোটার ছিল চার লাখ ৪০ হাজার ৫৬৬ জন। ওই নির্বাচনে মেয়র পদে তিন জন, সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনে ৪৫ জন ও ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৩৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর  মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।উচ্চ আদালতে রিট করে এক বছর ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর মেয়রের দায়িত্ব ফিরে পান মেয়র মনি।কিন্তু ক্ষমতা ফিরে পেলেও রাজনৈতিক ও আর্থিক চাপে বিভিন্ন প্রকল্প দাখিল করলেও মন্ত্রণালয় একটিও অনুমোদন করেনি।ফলে নির্বাচনি ইশতিহারে প্রতিশ্রুত ২১ দফা বাস্তবায়নে সফল হননি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

কেসিসি নির্বাচনের পরের বছর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।তবে এবারও তিনি মেয়র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন।তালুকদার আব্দুল খালেক ছাড়াও সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট সরদার আনিসুর রহমান পপলু ও দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আলী।খুলনা জাতীয় পার্টিতে যোগদানকারী এস এম মুশফিকুর রহমানকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।২০১৭ সালের ১৪ মার্চ খুলনা সার্কিট হাউজে কেক কেটে নির্বাচনি কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন মুশফিকুর রহমান।ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী খুলনা মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা মুজ্জাম্মিল হক কাসেমী।২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল মহানগরীর বাবরী চত্বরে সমাবেশ থেকে মেয়র প্রার্থীসহ কাউন্সিলর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।

খুলনা মহানগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গত নির্বাচনে ৬২ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। গত নির্বাচনে ৪১ কাউন্সিলরের মধ্যে বিএনপি পায় ২৪টি। বিজয়ের এ ধারা অব্যাহত রাখতে বিএনপির পূর্ব প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এবার ষড়যন্ত্র করে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচরি বৈতরণী পার করতে চায় এ অবৈধ সরকার, যা খুলনা বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করবে।’

মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক এমপি বলেন, ‘আমি নৌকার পক্ষের সৈনিক। নৌকার পক্ষেই আমার কাজ। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আসন্ন নির্বাচনে যার হাতে নৌকা তুলে দেবেন, আমি তার পক্ষেই অবস্থান নেবো।’খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কেসিসির মেয়র পদে নির্বাচন করার জন্য দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে মনোনয়ন পেতে আবেদন জানানো হবে। সভাপতি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা মাথায় নিয়ে নৌকার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবো।’ খুলনা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক এডভোকেট সরদার আনিসুর রহমান পপলু বলেন, ‘মেয়র নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।’

অন্যদিকে সাধারণ জনগন চায়, যে খুলনার উন্নয়নে সার্বিক দিক বিবেচনা করে যে অগ্রণী ভুমিকা পালন করবে তাকেই, খুলনার নগর পিতা হিসেবে সাধারন জনগন বেছে নিবে।এজন্য খুলনার সাধারণ জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানা যায়,তারা খুলনায় কেমন সিটি কর্পোরেশন চায়?

১। দিন নাই, রাত নাই এমনকি মৌসুমেরও বালাই নাই যখন যার খুশী রাস্তা কেটে নাগরিক সেবার কাজ করে। আজ হয়তো ওয়াসা পানির লাইন ঠিক করতে রাস্তা খুঁড়ছে কাল হয়তো ঠিক ঐ জায়গার একটু পাশে টিঅ্যান্ডটি টেলিফোন তারের লাইন মেরামতের জন্য লাইন খুঁড়ছে। পরশু হয়তো সুয়ারেজ লাইন পরিস্কারের কাজ করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এই যে বছর জুড়ে একই রাস্তায় অসংখ্যবার খোঁড়াখুঁড়ি, গর্তে পানি জমে থাকা, রাতে ঐ গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া অথবা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে ধুলো উড়ে স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি মোটেই নাগরিক সেবা নয়। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রাস্তা খোঁড়ায় সমন্বয়ের অভাব দীর্ঘদিনের। তাই নগর পিতাকে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে হবে। এসব খোঁড়াখুঁড়িতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একে অন্যের বিরুদ্ধে ঢিল ছুঁড়লেও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কাজের অনুমতি নিতে হবে। অনেক সময় জরুরি কাজে রাস্তা খোঁড়ার দরকার হয়, তাহলে ঐ কাজের জন্য স্থানীয়দেরকে সেটি দেখভালের বা সমন্বয়ের কাজে সঙ্গে রাখা দরকার। যাতে তারা বিষয়টি নিজেদের মনে করে দেখভাল করে।

২। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রাস্তার দু’ধারে এবং বিভিন্ন খোলা জায়গায় রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা জায়গা দখল করে অবৈধ দোকান করে ভাড়া দেয়। ফলে, যান ও জনজটের সৃষ্টি হয়। এসব দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এক্ষেত্রে নগর পিতাকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদে তৎপর হতে হবে।

৩। সিটি কর্পোরেশনের এলাকার খেলার মাঠ দখল করেছে হাউজিং কোম্পানি, স্থানীয় ভূমি দস্যু ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। মাঠের অভাবে প্রতিটি এলাকার কোমলমতি ছেলে-মেয়েরা খেলতে পারেনা। নগর পিতাকে মাঠ উদ্ধার করে সবার বিচরণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে।

৪। খুলনা সিটিতে সামান্য বৃষ্টি হলে পানি জমে চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়ে।বিশেষ করে নগরীর শান্তিধাম,সাতরাস্তা, সাউথ সেন্ট্রাল রোড, মুজগুন্নি আবাসিক, নিরালা সহ বেশ কিছু এলাকায় তাই সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে থাকা খালগুলো উদ্ধার করে পুনরায় খনন করা ও ড্রেনেজ ব্যাবস্থা আরো উন্নত করা আশু প্রয়োজন।

৫। মেগা সিটিগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা মাদক। এর ছোবলে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে নানা বয়সী মানুষ।বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এই মরণ ছোবলে। তাই মাদক মুক্ত নগরি গড়তে প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় সচেতন কমিটি গঠন করার দায়িত্ব মেয়রককেই নিতে হবে।

৬। এলাকায় নানা সমস্যা মেটাতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নাগরিক ফোরাম তৈরি করতে হবে।যেন, কথায় কথায় মেয়রের কাছে নাগরিকদের যেতে না হয়। তাই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নাগরিক কমিটি গঠন করে পাড়া-মহল্লার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা কাউন্সিলকে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন।

৭। খুলনার অন্যতম সমস্যা নোংরা আবর্জনা ও ভাগাড়ের ময়লা। যত্র-তত্র মানুষ ময়লা ফেলছে। রাস্তায় ও লেকের পানিতে ফেলছে। ডাস্টবিনে না ফেলে পাশের জায়গায়ও ফেলছে। তাই নগরবাসীকে সচেতন করার পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট চালু রাখতে হবে যাতে মানুষ যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে।

৮। ময়লা-অবর্জনা নির্দিষ্ট জায়গার ‘বিনে’ ফেলার পাশাপাশি পুরো শহরের ময়লা-আবর্জনা অপসারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। যাতে তারা ঐ ময়লা রিসাইক্লিং করতে পারে।

৯। বাংলাদেশেই রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঝুলন্ত তার দেখা যায় যা বিশ্বের কোথাও দেখা যায়না।খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে এই ঝুলন্ত তারগুলো মাটির নীচ দিয়ে পরিবহণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজটি করতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে।

১০। মশায় অতিষ্ট নগরবাসী। তাই মশা নির্মূলে সিটি কর্পোরেশন থেকে নিয়মিতভাবে মশক নিধন স্প্রে করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা জরুরি।

১১। যানজট নিরসনে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকে জবাবদিহিতায় আনতে আইন সংশোধন জরুরি। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকে কর্পোরেশনের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

এখন দেখার বিষয় খুলনা সিটি কর্পোরেশন নগর পিতা নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণকে দেয়া তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি মানতে তারা সচেষ্ট হবেন নাকি মেয়র নির্বাচিত হয়ে সব প্রতিশ্রুতি ভুলে সুবিধাবাদীর আচরণ করবেন।